বেশ কিছুদিন ধরেই এবেলা-র মাধ্যমে আমি আপনাদের দেশ-বিদেশের নানা অলৌকিক বৃত্তান্ত শুনিয়ে চলেছি, আপনাদের কারোর ভালো লেগেছে, কারোর লাগেনি৷ এতদিন আমার আলোচ্য বিষয় ছিল প্রেততত্ত্ব, অর্থাৎ মৃত্যুর পরে মানুষের কী হয়, কেমন করে মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় ইত্যাদি৷ এবারে আপনাদের একটি প্রশ্নের মুখোমুখি করতে চলেছি— মৃত্যু মানে একটি জীবনের শেষ, কিন্তু সেই মানুষটিরও কি শেষ ? যে মানুষটিকে এতদিন ধরে দেখেছি, যাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁর কাছে হয়তো অনেক কিছু শিখেওছি, যাঁর বন্ধুত্ব, প্রীতি, ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবন কাটিয়েছি, তাঁর দেহপাতের সঙ্গে সঙ্গে কি সব এক মুহূর্তের মধ্যে সমাপ্ত হয়ে যায় ? মৃত্যুর আসল সত্য কী ? এই নিয়ে দেশে বিদেশে অনেকে পড়াশুনা করছেন, অনেক গবেষণা চলছে নানান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, কখনও মনে হয়েছে এই বুঝি সত্য উদ্ঘাটন হয়ে গেল। কিন্তু তার পরেই এমন কিছু নতুন তথ্য সামনে এসে পড়ে, যার ফলে সব জানা তথ্যগুলো যেন গোলমাল হয়ে যায় ৷ সদুত্তর মেলে না সেই প্রথম দিনের প্রশ্নের— মৃত্যুর পরেও কি কিছু থেকে যায় ?
আত্মা, মৃত্যু, মরণোত্তর জীবন নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন তাঁদের মতো আমিও বিশ্বাস করি, মৃত্যু আমাদের জীবনের একটা অধ্যায়, শেষ কথা নয়৷ এই জীবনের আগেও অস্ত্বিত্ব ছিল, এই জীবনের পরেও থাকবে৷ জাতিস্মর তার পূর্ব পূর্ব জন্মের কথা ভুলে যায় না৷ জাতিস্মরতত্ত্বের মূল কথা হল— মৃত্যুর পরে দেহ শেষ হয়ে গেলেও মানুষের অবচেতনে জন্মান্তরের স্মৃতি থেকে যায় ৷ এই বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ কেউ দেননি কিন্তু বারে বারে নানা ভাবে, নানা ভাষায় এই বিশ্বাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে৷ ১৯১৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, তখন ইউরোপে শুরু হয়ে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, প্রত্যহ শত শত সৈন্য রণক্ষেত্রে প্রাণবলি দিচ্ছে৷ রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসে সূর্যাস্তের রঙের ছটা দেখতে দেখতে অনায়াসে লিখে ফেললেন—
‘‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার, যায় চলে আলোকে ৷’’
আমি অনেকবার ভেবেছি, রবীন্দ্রনাথ কেন এই কথাগুলি লিখলেন ? এই গান লেখার সময়ে তাঁর বয়স তিপ্পান্ন বছর৷ নিজের জীবনেও রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর এক মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখেছিলেন বলা যায়৷ মাত্র দশ বছর বয়েসে মা’র মৃত্যু দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই মৃত্যুমিছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনে শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রয়ে গেছে, নিয়মিতভাবে এক এক করে তাঁর প্রিয়জনেরা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন৷ কিন্তু তবু এক আশ্চর্য পরিপূর্ণতা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল৷ সেই অনুভুতি থেকেই হয়তো তাঁর মনে হয়েছে, মৃত প্রিয়জনের হারিয়ে যাননি, এই বিশাল বিশ্বে পথ চলতে চলতে একদিন আবার দেখা হবে৷ এই বিশ্বাস থেকেই সম্ভবত তিনি প্ল্যানচেটের মাধ্যমে মৃত স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন৷
অসংখ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমারও মনে হয়েছে মৃত্যুতে সব শেষ হয় না৷ জীবনের চক্র ঘুরতেই থাকে৷ আর বিদেহী আত্মার অস্তিত্বকে মেনে নিলেই আলোচনার পরিসরে ভূত ছাড়াও এসে পড়ে আরও কতগুলি বিশ্বাস— জন্মান্তরবাদ, জাতিস্মর, পুনর্জন্ম, সম্মোহন এবং জীবিত মানুষের শরীর বা মনের উপরে আত্মার অধিকার প্রতিষ্ঠা, যাকে চলতি বাংলায় 'ভর ' বলা হয় ৷ এসবই এক সময় নিছক কল্পনা বা 'ঠাকুমা-দিদিমার গপ্পো ' মনে করা হতো, কিন্তু এখন বিজ্ঞানীদের কাছে এগুলি বিশেষ মর্যাদা পেতে শুরু করেছে৷ এদের মধ্যে ভূত নিয়ে তো অনেক কথাই হয়েছে, এবার জন্মান্তরবাদ ব্যাপারটা আলোচনা করা যাক৷
জাতিস্মর মুকুল। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪)
আমাদের দেশের যুক্তিবাদী বিদ্যেবোঝাই বাবুমশায়ের দল জন্মান্তরবাদ নিয়ে হাসি-তামাশা করলেও, পশ্চিমের বিজ্ঞানীমহল কিন্তু ব্যাপারটার মধ্যে একটা রহস্য লুকিয়ে আছে, একথা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন এবং এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মনোবিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা গত কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে যার বৈজ্ঞানিক নাম Parapsychology, বাংলায় পরামনোবিদ্যা৷
Parapsychology সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতে যাঁরা বাঙালি পাঠককে উৎসাহিত করেছেন তাঁদের মধ্যে সবথেকে আগে মনে পড়ে সত্যজিৎ রায়ের নাম৷ ‘সোনার কেল্লা’ রহস্যোপন্যাসে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির ছোট্ট ছেলে আট বছরের মুকুল হঠাৎ একদিন বলতে শুরু করল তার আসল বাড়ি সোনার কেল্লার মধ্যে৷ এর পর মুকুলের আর কলকাতার বাড়ি, মা বাবা, কিছুই পছন্দ হয় না, সে ফিরে যেতে চায় তার সেই বাড়িতে যেখানে ময়ূর আছে, অনেক চকমকে পাথর আছে, যা দিয়ে গয়না তৈরি হয়৷ গল্পে ঢুকে পড়লেন বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট ডাঃ হেমাঙ্গ হাজরা, যাঁর কাছে মুকুল একটি দুর্লভ specimen৷ তিনি মুকুলকে নিয়ে বের হলেন সোনার কেল্লার খোঁজে৷ তাঁদের পিছু নিল এক বিপদজনক অপরাধী ভবানন্দ ও তার বেপরোয়া সাকরেদ, এদের লক্ষ্য মুকুল কথিত সোনা-দানার সন্ধান পেয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়া৷ এত বড় রহস্যর খোঁজ পাবার পরে তো ফেলুমিত্তির আর তোপসে কলকাতায় বসে থাকতে পারে না, তারাও ট্রেন ধরে পাড়ি দিল রাজস্থানে৷ যাওয়ার আগে ফেলুদা তার স্বভাবমতো একবার সিধুজ্যাঠার কাছে গিয়েছিল এই ব্যাপারে কিছু তথ্য পাওয়া যায় কি না জানতে৷ সিধু জ্যাঠা ডাঃ হাজরা সম্পর্কে কিছু তথ্য দিলেও Parapsychology ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি৷ তাঁর ভাষায় এটা হলো — " পাড়া - ছাই - চলো - যাই"৷
সত্যজিৎ রায় নিজে কিন্তু বিষয়টিকে তেমন দুরছাই করতেন না৷ তিনি ফেলুদাকে দিয়ে দু-দু’বার Parapsychologyর ব্যাখ্যা করিয়েছেন ৷ একবার তোপসেকে বোঝাতে গিয়ে ফেলুদা বলেছে — "মানুষের মনের কতকগুলো বিশেষ ধরণের ধোঁয়াটে দিক নিয়ে যারা চর্চা করে, তাদের বলে প্যারাসাইকোলজিস্ট৷ যেমন টেলিপ্যাথি৷ একজন লোক আর একজনের মনের কথা জেনে ফেলল..... আরও আছে ৷ যেমন Extra Sensory perception—যাকে সংক্ষেপে বলে ESP ৷ ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা আগে থেকে জেনে ফেলা৷ এই যে জাতিস্মর— পূবর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যাওয়া, এগুলো সবই হচ্ছে প্যারাসাইকোলজিস্টদের গবেষণার বিষয় ৷"
নকল ডাঃ হেমাঙ্গ হাজরা আর মুকুল। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪)
তোপসে তো যা বোঝার বুঝে নিল কিন্তু লালমোহনবাবু তো অরিজিন্যাল দৃষ্টিভঙ্গীর মানু৷ তিনি প্যারাসাইকোলজি শব্দটা শুনে দু’বার খাবি খেয়ে প্রশ্ন করলেন— "সাইকোলজির আগে যে আবার প্যারা বসে, তাতো জানতুম না মশাই ৷ টাইফয়েডের আগে বসে, সেটা জানি ৷ তার মানে কি হাফ-সাইকলজি ? প্যারা টাইফয়েড যেমন হাফ-টাইফয়েড ?’’
ফেলুদা উত্তর দিয়েছিল— "হাফ নয়, প্যারা মানে আ্যাবনর্মাল৷ মনস্তত্ত্ব ব্যাপারটা এমনই ধোঁয়াটে আর তার মধ্যে আবার যেদিকটা বেশী ধোঁয়াটে, সেটা প্যারাসাইকোলজির আন্ডারে পড়ে৷"
সুদূর ১৯৭১ সালে প্যারাসাইকোলজি খায় কি মাথায় দেয়, তা অনেকেই জানতেন না ৷ শব্দটা বার বার বোঝানোর এই প্রয়াস পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছিল, সত্যজিৎ নিজেও আশঙ্কা করেছিলেন তাঁর পাঠকদের পক্ষে এই নতুন তত্ত্ব একটু গুরুভার হয়ে উঠতে পারে ৷ কিন্তু তিনি নিজে বিষয়টি নিয়ে এতটাই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, রহস্যের পটভূমি বাদ দিয়ে একটা সাদামাটা পুনর্জন্মের গল্প লিখতে চান নি৷ রোমহর্ষক একটি উপন্যাস লিখে আবার সেই কাহিনি নিয়ে অনবদ্য একটি সিনেমা বানিয়ে সত্যজিৎ মনে হয় তাঁর পাঠককুলকে প্যারাসাইকোলজি সম্পর্কে যথেষ্ট উৎসাহিত করতে পেরেছিলেন৷ জাতিস্মরবাদ যে ছোট-বড় সকলের কাছেই বেশ একটি মনোজ্ঞ বিষয় তার প্রমাণ ‘সোনার কেল্লা’ উপন্যাস এবং সিনেমা— দুটোই আজও বেস্টসেলার৷
(ক্রমশ)