সভ্যতার আদি যুগ থেকেই মানুষ প্রেতযোনির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিল। আদি কাব্য-সাহিত্য-দর্শনে তার বহু নমুনা ছড়ানো রয়েছে। এই দু’টি বিশ্ব— নরলোক আর প্রেতলোক, কিছুটা সমান্তরালভাবেই চলত। অন্য ভুবনের বাসিন্দাদের সম্বন্ধে নরলোকের অধিবাসীদের ধারণা কালক্রমে বদলায়। বাল্মীকি রামায়ণে দশরথের মৃত্যুর পরে রামচন্দ্রের যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, তার থেকেই এই মনোভাব স্পষ্ট হবে।
দশরথ যখন দেহত্যাগ করেন, রাম তখন বনবাসে, সুতরাং এই দুঃসংবাদ তাঁর জানা ছিল না। অনতিবিলম্বে ভরত দশরথের তিন রানি ও গুরু বশিষ্ঠকে নিয়ে রথে করে বনের দিকে রওয়ানা হলেন। বনের কাছে রথ থামিয়ে ভরত একা অরণ্যে ঢুকে রাম ও লক্ষ্মণকে সব কথা জানালেন। এ পর্যন্ত যা হল, তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পরের অংশটি কিছুটা ব্যতিক্রমী. লক্ষ্মণ ও ভরত প্রথমেই রামকে অনুরোধ করলেন পিতৃতর্পণ করতে এবং রামও তাতে রাজী হয়ে গেলেন। রাম তখনই নদীতে নেমে তাঁর পুণ্য সলিল অঞ্জলিভরে নিবেদন করে বললেন, ‘মহারাজ, এই জল যেন চিরকাল আপনার তৃষ্ণা দূর করে’। তার পর বনের গাছ থেকে আহরিত কিছু ফল ঘাসের উপরে রেখে সাশ্রুনয়নে বললেন, ‘মহারাজ, এই আমাদের আহার্য্য, আপনিও দয়া করে আহার করুন, কেন না মানুষের যা খাদ্য, তা দেবতাদেরও খাদ্য হয়ে থাকে’।
আমরা এ থেকে কি বুঝলাম? আদর্শ মানুষ, পুরুষোত্তম রামচন্দ্র পথশ্রমে ক্লান্ত মা এবং গুরুকে রথে বসিয়ে রাখলেন, কিন্তু প্রয়াত পিতার তুষ্টিসাধনে মুহূর্তও বিলম্ব করলেন না। আরও চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হল, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পিতা দেবত্বে প্রোমোশন পেয়ে গেলেন (মানুষের যা খাদ্য, তা দেবতাদেরও খাদ্য হয়ে থাকে-র অর্থ তাই দাঁড়ায়) এবং ইঙ্গিত করা হল যে, খাদ্যগ্রহণের মত প্রাত্যহিক নিত্যক্রিয়ার মধ্য দিয়েও তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে যোগ রাখবেন।
রামায়ণী সমাজে মৃত স্বজনের প্রতি মানুষের ভয়, ভক্তি ভালোবাসা তিনটেই ছিল। আর অন্য ভুবনের সঙ্গে একটা যোগসূত্রের আভাসমাত্র ছিল। পরবর্তী মহাকাব্যগুলিতে সেই সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে। ইলিয়াডে হোমার তাঁর নায়ক ওডিসিউসকে পরলোকের কন্ডাক্টেড ট্রিপ করিয়ে এনেছেন। মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের নরকদর্শনও এই পর্যায়েই পড়ে। অবশ্য তার অনেক আগে বনবাসের মধ্যে মহাবীর অর্জুন শুধু স্বর্গেই যাননি, সেখানে ছুটিও কাটিয়ে এসেছেন। কিন্তু বেদব্যাসের মাস্টারস্ট্রোক মহাভারতের স্ত্রীপর্বে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরে যেদিন যুদ্ধে মৃত যোদ্ধাদের গণ-শেষকৃত্যের আয়োজন করা হল, সেদিন হস্তিনাপুর নগরীতে শোকের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, পতিপুত্রহারা রমণীগণের করুণ ক্রন্দনে আকাশ বাতাস মথিত হয়ে উঠেছিল। সব কৃত্য শেষ হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ দেখা গেল, কুরুবংশের আদিপুরুষ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস অন্ধকারে নদীগর্ভে প্রবেশ করছেন। একটু পরে এক অদ্ভুত আলোয় নদীর কালো জল আলোকিত হয়ে উঠল। তার পর শোকবিহ্বলা নারীদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে নদীগর্ভ থেকে যুদ্ধে মৃত সেনারা একে একে উঠে এল। মহাযুদ্ধের প্রায় পক্ষকাল পরে কুরুপাণ্ডবের সম্মিলিত অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী আবার পরস্পরের মুখোমুখি হল। কিন্তু এবার তাদের মধ্যে কোনও শত্রুভাব ছিল না, সব হিংসা বিসর্জন দিয়ে তারা শুধু নিজের প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হল। স্বপ্নের মতো রাত কেটে গেল, সূর্যোদয়ের প্রাকমূহূর্তে সেই বিশাল মায়াবাহিনী আবার নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেল।
বিশ্বসাহিত্যে এই বর্ণনার জুড়ি নেই। কিন্তু জানি না এই উপাখ্যান নিছক কবিকল্পনা কি না। কেন না স্বয়ং মহাভারতকারই তো এই অলৌকিকের সংগঠক ও সঞ্চালক। আর ব্যাসদেব তো খুব সোজা লোক ছিলেন না। আমাদের শাস্ত্রোক্ত সপ্ত অমরের তালিকায় সকলেই রাজা-রাজড়া বা শূরবীর, একমাত্র তিনিই ঋষি ও কবি। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার বহু নিদর্শন মহাভারত ও অন্যান্য শাস্ত্রে ছড়ানো রয়েছে। তিনি জন্মেজয়ের সঙ্গে পরীক্ষিতের সাক্ষাৎ ঘটিয়েছিলেন, যদিও পরীক্ষিত তখন মৃত। কুরুক্ষত্রযুদ্ধের আগে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে চক্ষুদান করতে চেয়েছিলেন, যদিও অন্ধ রাজা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এত যাঁর ক্ষমতা, তাঁর পক্ষেই এই মহানাটকের পুনরাভিনয় করানো সম্ভব। হয়তো যোগবলে তিনি প্রেতলোকের উপরে আধিপত্য করতেন, তাই বিধির বিধান উল্টে দিয়ে এক রাতের জন্য সেই লোকের অধিবাসীদের নরলোকে নিয়ে এসেছিলেন। কিংবা গোটা ব্যাপারটা হয়তো পি, সি, সরকার বা হুডিনির মতো গণসম্মোহনের ভোজবাজী। সঠিক বলা অসম্ভব।
মহাভারতের যুগে আমাদের সমাজ জীবন জটিল হতে শুরু করলো. আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বহুলাংশে ভোগবাদী হয়ে উঠল। ঋষি-মুনি-পুরোহিত সম্প্রদায় ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা প্রবল পরাক্রান্ত রাজশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আস্তে আস্তে অন্য জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে এল। অলৌকিকের সঙ্গে আবছামতো যে লৌকিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার ধারা বহন করে চললেন ব্যাসদেবের মতো কয়েকজন শক্তিধর ঋষি, তা আর সাধারণের আয়ত্তে রইল না। এইখানে বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি গল্প মনে পড়ছে। রাজর্ষি জনকের সভায় একবার মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য নিজেকে শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞ বলে দাবি করায় সমবেত পণ্ডিতকুল তাঁকে বহু চোখা চোখা প্রশ্ন করে বিব্রত করার চেষ্টা করেন— স্বাভাবিক, কেন না শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মজ্ঞের প্রাইজ মানি ছিল ৫০,০০০ গাভী ও অন্যান্য ধনরত্ন। সেই সভায় অন্তত দু’জন ঋষি জানান যে, ছাত্রাবস্থায় তা্ঁরা যজ্ঞ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের জন্য পাতঞ্জল কাপ্য নামে এক ঋষির কাছে যেতেন। ঋষির পত্নী ও কন্যার উপরে এক গন্ধর্ব অথবা কবন্ধ ভর করত এবং আবিষ্ট অবস্থায় ওই দুই মহিলা বহু কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতেন। অর্থাৎ তাঁরা শক্তিশালী মিডিয়াম ছিলেন। এটাও বোঝা যায় প্রাচীন ভারতে জ্ঞানলাভের জন্য প্রেতচর্চায় বাধা ছিল না। এই ঘটনাটিকে অনেক পণ্ডিতই ভারতীয় সাহিত্যদর্শনের প্রথম ভৌতিক গল্প বলে মনে করেন।( পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য জানিয়ে রাখি, যাজ্ঞবল্ক্যের বেস্ট ব্রহ্মজ্ঞের ট্রোফি পেতে কোন অসুবিধা হয়নি, পরমানন্দে তিনি গরুর পাল নিজের আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলেন। গোরক্ষকেরা শুনলে খুশি হবেন না, কিন্তু বিফ বিরিয়ানির উপরে তাঁর প্রবল আসক্তি ছিল।)
আদি উপনিষদগুলি সম্ভবত লেখা হয়েছিল খ্রিস্টজন্মের কমবেশি তিন হাজার বছর আগে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে এই জ্ঞানের ধারাটি লুপ্ত হয়ে গুহ্যবিদ্যায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং বিপুল অবিশ্বাস ও উপহাসের সম্মুখীন হয়েছে। অন্য ভুবনের বাসিন্দারাও সামনে দাঁড়াতে আগ্রহী হননি। প্রায় একশো সত্তর বছর আগে কেন জানি না, দুই জগতের মাঝখানের ছিটকিনি আঁটা একজটা দেবীর জানলাটা প্রায় খুলে যাচ্ছিল, তাও আবার ঘটতে যাচ্ছিল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ খোদ মার্কিন মুল্লুকে।
সেই গল্পই আপনাদের শোনাবো। তবে, পরের পর্বে...