জন্মান্তর প্রসঙ্গে একটা কথা খুব বলা হয়— বেশির ভাগ জাতিস্মরের ঘটনা ভারত আর তিব্বত থেকে শোনা যায়, কেন না সেখানকার মানুষ এই মতে বিশ্বাসী। অন্যান্য দেশে বিশ্বাস কম বলে ঘটনাও কম। কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। তিব্বতকে এই আলোচনায় রাখাই ঠিক নয়, কেন না এটি পৃথিবীর একমাত্র দেশ, জন্মান্তরবাদ যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। জন্মান্তরবাদ সেখানে জীবনের ভিত্তি। আমরা এই প্রসঙ্গে পরে আসবো, কিন্তু এটুকু বলে রাখি পৃথিবীর সর্বত্র জন্মান্তরের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইয়ান স্টিভেনসন তাঁর সারাজীবনের গবেষণা ও বিশ্বভ্রমণ দিয়ে তা প্রমাণ করেছেন। আমার নিজের ভাল লাগা একটি জাতিস্মরের উপাখ্যানের মাধ্যমে এ কথাই বোঝাবার চেষ্টা করবো যে, জাতিস্মরের জাতি-ধর্ম-দেশের বেড়া থাকে না।
উনিশ শতকের একেবারে শেষে, ১৮৯৮ সালে জার্মানিতে আর্নেস্ট লোথার হফম্যানের জন্ম হয়। তিনি ধনীর সন্তান ছিলেন, বেশ আরামেই জীবন কাটাতেন। তাঁর যৌবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, তাঁকে বাধ্যতামূলক সামরিক কর্তব্যে যেতে হয়। সেখানে তাঁর শরীর খারাপ হল, পরীক্ষায় জানা গেল রাজরোগ অর্থাৎ যক্ষ্মা। যুদ্ধবিগ্রহ ছেড়ে তিনি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য ইতালির কাপ্রি দ্বীপের এক আরোগ্যনিকেতনে ভর্তি হলেন। একদিন সময় কাটানোর জন্য প্রেতচক্রে বসলেন। কিছুটা তামাশা করেই তিনি আগত আত্মাকে প্রশ্ন করলেন— গত জন্মে তিনি কে ছিলেন? উত্তর এল— নোভালিস। চক্রের অন্য সঙ্গীরা হাসাহাসি শুরু করলেন, কিন্তু হফম্যানের মনে হল, নামটা চেনা-চেনা। তাঁর মনে পড়ল, কোনও গ্রন্থের পাদটীকায় তিনি নামটি দেখেছিলেন— প্রায় একশো বছর আগে এক জার্মান সাহিত্যিক এই ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন।
অনাগারিক গোবিন্দ বা আর্নেস্ট লোথার হফম্যান, ছবি: উইকিপিডিয়া
হফম্যান ভালো ছবি আঁকতেন, অল্পবিস্তর সাহিত্যচর্চাও করতেন। এই ঘটনার কিছুদিন পরে তিনি একটি ছোটগল্প লিখে তাঁর এক বন্ধুকে পড়তে দেন। বন্ধুটি জার্মান সাহিত্য নিযে পড়াশোনা করত। সে পড়ে কিছুটা অবাক হয়ে হফম্যানের কাছে জানতে চাইলো— নোভালিসের লেখা তিনি কতটা পড়েছেন, কেন না তাঁদের দুজনের লেখায় প্রচুর মিল। আগেই বলেছি, হফম্যান নোভালিসের নাম ছাড়া কিছু জানতেন না। এবার নোভালিসের লেখা পড়তে গিয়ে তাঁর মনে হল, এ তাঁর নিজেরই লেখা। নোভালিস একটি উপন্যাস লিখতে লিখতে মারা যান। হফম্যানের মনে হল, তাঁর গল্পটিকে সেই অসমাপ্ত উপন্যাসের অংশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, ভাষা, লিখনশৈলী, এমনকী কিছু কিছু অণুচ্ছেদ পর্যন্ত এক। অনুসন্ধান করে জানা গেল, নোভালিস, যাঁর আসল নাম ছিল জর্জ ফিলিপ ফ্রায়েডরিখ হোল্ডেনবর্গ, হফম্যানের মতো অল্পবয়সে টি বি রোগের শিকার হন, কাপ্রির স্যানাটোরিয়ামে তাঁকেও থাকতে হয়েছিল এবং মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনান্ত হয়। সুখের কথা, নোভালিসের মতো হফম্যানের জীবন বিয়োগান্ত হয়নি।
এই ঘটনা তাঁর জীবনে গভীর ছাপ ফেলে। তিনি কাপ্রিতেই এক আমেরিকান বন্ধুর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা শুরু করেন। রোগমুক্তির পরে তিনি সিংহলদ্বীপে— আজকের শ্রীলংকায়— এসে হীনযান মতে দীক্ষিত হন এবং বৌদ্ধ শ্রমণের জীবন যাপন করতে থাকেন। তাঁর নাম হয় অনাগারিক গোবিন্দ। কয়েক বছর পরে, ১৯৩১-এ দার্জিলিং ও সিকিমে এসে তিনি তাঁর গুরু লামা তোমো গেসে রিম্পোচের দেখা পান এবং তাঁর জীবনের মোড় আবার ঘুরে যায়। শীঘ্রই তিনি তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধদর্শনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিরিশের দশকে তিনি শান্তিনিকেতনে ফরাসি ও জার্মান পড়িয়েছেন, কলকাতায় তাঁর ছবির প্রদর্শনীও জনপ্রিয় হয়েছে। দীর্ঘদিন তিনি দার্জিলিং-এ বাসও করেছেন।
অনাগারিক গোবিন্দ, লি গোতমী ও নয়নপোনিকা থের, ছবি: উইকিপিডিয়া
গোবিন্দ তাঁর কর্মজীবনে অনেক কিছু করেছেন। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের উপরে তাঁর প্রামাণ্য গ্রন্থ আছে, একাধিক বার তিনি বৌদ্ধ শ্রমণদের সংগঠন গড়ে তুলেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দেহরাদুনের কাছে অন্তরীণ রাখে। কেন না তিনি একে জন্মসূত্রে জার্মান, তার উপর নেহরু পরিবারের ঘনিষ্ঠ। যুদ্ধ শেষ হলে তিনি কিছুদিন আলমোড়ার কাছে আশ্রমও করেছিলেন। ভারত স্বাধীন হবার পরে তিনি বিবাহও করেন, পাত্রী তাঁর শান্তিনিকেতনের ছাত্রী পার্শি কন্যা রতি পেতিত (আশ্চর্য সমাপতন, মহম্মদ আলি জিন্নার পত্নীরও এই নাম ছিল), কেন জানি না, বিয়ের পরে তাঁর নতুন নাম হয় লি গোতমী। লর ভাল ছবি আঁকতেন, চল্লিশের শেষে তাঁরা হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত পৌঁছন। চিন অধিকার করার আগে তাঁরাই সম্ভবত তিব্বতের শেষ বিদেশী পর্যটক। তিব্বত বিষয়ে তাঁদের ছবি ও ফোটোগ্রাফের সংকলন ওই নিষিদ্ধ দেশের জীবনযাত্রার এক মূল্যবান দলিল হয়ে রয়েছে। এই তিব্বত যাত্রার বিবরণ নিয়েই লেখা তাঁর বিপুল জনপ্রিয় বই— The Way Of White Clouds। ভ্রমণ, দর্শন ও আত্মস্মৃতির এরকম নিখুঁত মিশ্রণ খুব কম আছে।
অনাগারিক গোবিন্দের লেখা কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, ছবি: আমাজন.ইন-এর সৌজন্যে
পাঠক, লক্ষ্য করেছেন কি, এক খাস জার্মান সাহেবকে নিয়ে কথা বলতে গিয়েও আমরা অনায়াসে তিব্বত পৌঁছে গেলাম? বোঝা গেল, জন্মান্তরের আলোচনায় তিব্বতকে বাদ দেওয়া যাবে না। চলুন আমরাও ওদিকেই চলি।
(ক্রমশ)