(পূর্ব কাহিনি— গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে সাহসিনীর অস্ত্রোপচারের পরের দিন। ডাক্তারনী এসে জানালেন, সাহসিনীর শরীরে এইচআইভি পজিটিভ-এর সংক্রমণের লক্ষণ মিলেছে। আগে কোনও দিন এইচআইভি পজিটিভ-এর নামই শোনেনি সে। ফলে সাহসিনীর মাথায় কিছুই ঢুকল না।)
ডাক্তারনী বেরিয়ে গেল। আমি দরজাটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলাম। তখনই আমার চোখ দিয়ে হালকা করে জলটা বেরিয়ে এসে গাল বেয়ে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে চোখের জলটা আটকানোর চেষ্টা করছিলাম। আসলে যে স্নেহের জন্য গত এক বছর ধরে ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলাম, তার স্বাদ যে এক অচেনা-অজানা মহিলা ডাক্তারের কাছ থেকে এভাবে পাব তা ভাবতেই পারিনি।
বেলা গড়িয়েছে। কাঁচের জানলার পরদাটা সরানো। বাইরের আকাশটায় রোদ ভরাট হয়ে আছে। ভাবছি এই হাসপাতাল থেকে ছুটি করে দিলে কোথায় যাব। আমার বাড়ির লোকও তো এসে পৌঁছয়নি। কী-ই বা করব আমি? সাত কূল ভেবে থই পাচ্ছি না।
হঠাৎ-ই মা-এর গলাটা যেন কানে এল। ঘুমোর ঘোরে ভাবছি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু, মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা ঘুমভাঙা চোখটা তখনও ঠিক করে খুলতে পারিনি। চোখটা জ্বালা করছে। তাও কোনও মতে চোখটা পুরো খুললাম। দেখলাম সত্যি সত্যি মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
মা-কে দেখে আমিও তখন বিছানায় সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করছি। ওদিকে, নার্স আর ওয়ার্ডবয়রা তখন আইসিইউ-এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা সমানে বলে চলেছে, এটা আইসিইউ। এখানে এত চিৎকার করবেন না। রোগী প্রচণ্ডই অসুস্থ। ওর অসুবিধা হবে। কিন্তু, মা-এর স্নেহ কি কোনও বিধিনিষেধ মানতে পারে! বিশেষ করে যে মেয়ে আচমকাই হারিয়ে যায়, তার ক্ষেত্রে? সময়ের অমোঘ খেয়ালে প্রায় এক বছরের মাথায় সেই মেয়েকে মা যখন ফিরে পায় তখন তারা নিজেদের বাড়ি থেকে হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে একে অপরের মুখোমুখি। এই অবস্থায় মা ও সন্তানের মনের অবস্থা কী হয় তা অন্যরা বুঝবে কী করে?
মা থাকতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে আমার বেডের পাশে এসে বসে পড়েছিল। দু’হাত দিয়ে আমার মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এমন কান্না শুরু করল যা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। আমিও পারিনি, মাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে নিজের চোখকে নির্জলা রাখতে। হাপুস নয়নে আমিও মা-কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছি।
আমার পরিবারের বাইরে যিনি সব থেকে বেশি এই ক’দিন ধরে আমাকে আগলে রেখেছিলেন সেই মহিলা চিকিৎসক এগিয়ে এসে মা-কে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু, কোনও কাজ হল না। মা-তার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘যে আমার সন্তানের এই হাল করেছে তাকে আমি ছাড়ব না। তাকে যেন ফাঁসি দেওয়া হয়।’ এই বলে মা ফের আমাকে জড়িয়ে ধরল। ছাড়তেই ছাইছে না আমাকে। দেখলাম দাদা এগিয়ে এসে মা-কে শান্ত করার চেষ্টা করছে। দাদা-কে দেখে আমি তাকেও জড়িয়ে ধরলাম। দাদাও কাঁদতে থাকল।
তবু, মা-এর মতো বেসামাল হল না দাদা। কারণ, আইসিইউ-এ তখন ভীড় লেগে গিয়েছে। কে নেই? সেই মহিলা ডাক্তার থেকে শুরু করে যে লোকটা আমাকে বেডে তুলে চিকিৎসা করানোর বন্দোবস্ত করেছিল, এবং এতদিন ধরে ছোটাছুটি করে থানা-পুলিশ করেছে সেই লোকটা। পুলিশ। আরও অনেকে। এদের মধ্যে খুব কম লোককেই আমি চিনি।
আরও পড়ুন
চিকিৎসক জানালেন আমি ‘এইচআইভি আক্রান্ত’, বুঝতেও পারলাম না’
‘অপারেশন থিয়েটারের ঘরটা অদ্ভুত ঠান্ডা। চারিদিকে কেমন যেন অন্ধকার’
‘আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী খাব? আমার মুখ দিয়ে বের হল পায়েস’
‘আমার চারপাশটা অন্ধকার হতে লাগল।আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ হয়ে এল আমার’
ওয়ার্ডবয় একটা চেয়ার নিয়ে এসে মা-কে তাতে বসতে দিল। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে। আর সমানে বিলাপ করছে, যদি গিয়াসউদ্দিন একটু সাহায্য করত, যদি পুলিশটা তৎপর হত, তাহলে আজ এই পরিস্থিতি হত না। আমার নাম করে মা বলতে লাগল,—‘কতবার পুলিশের হাতে-পায়ে ধরলাম। তোর দেওয়া দিল্লির ঠিকানা, গাড়ির নম্বর সবই দিলাম, কিন্তু পুলিশ কিছুই করল না। গরিব বলে আমাদের কথাই শুনল না। টাকা জোগাড় করে দিল্লি আসব ভেবেছিলাম, কিন্তু সেটাও আমরা তোর জন্য করে উঠতে পারিনি। তোর এই অভাগা মা-কে ক্ষমা করে দিস।’
আস্তে আস্তে পুলিশই ঘর থেকে অপ্রয়োজনীয় লোকদের বের করে দিল। নার্স এবং ওয়ার্ডবয়রাও সাহায্য করল। ঘরে এখন শুধুই আমি, মা, দাদা এবং সেই মহিলা ডাক্তার এবং কয়েক জন নার্স। ডাক্তারনীই মা-কে বলল,— ‘আপনাকে এবার বাইরে আসতে হবে। অনেক কথা বলার আছে। ওর এবার একটু ঘুমানো দরকার।’ ডাক্তারনী আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘কী, এখন একটু ভাল লাগছে? চিন্তা করো না, এবার তুমি ভাল হয়ে যাবে। এখন লক্ষ্ণী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ো।’ এরপর মা-কে সঙ্গে করে ডাক্তারনী আইসিইউ-এর বাইরে চলে গেল। শূন্য ঘরে এসির ঠান্ডা যেন ফের গায়ে অনুভব করলাম। আস্তে আস্তে ক্লান্ত শরীরে ঘুম যেন ছেয়ে গেল।
(ক্রমশঃ)