দশ বছরের মিষ্টি ছেলে অস্কার। বেশ খানিকটা দুষ্টুও। সে তো আর পাঁচটা ওই বয়সের বাচ্চা হয়েই থাকে। তা হলে অস্কারকে নিয়ে গপ্পো কেন? অস্কারের দুষ্টুমি, ইম্যাজিনেশন ইত্যাদির পরেও একটা এমন জগৎ রয়েছে, যা ওই বয়সের বেশিরভাগ বাচ্চারই থাকে না। কারণটা জানলে আপনিও থমকে যাবেন। অস্কার ঠিক যে জায়গাটায় অন্য বাচ্চাদের চাইতে আলাদা, সেটা একটা অসুখ। আর সেই অসুখটার নাম ক্যানসার। এমনটা ভাববেন না যেন, অস্কার জানে না ওর কী হয়েছে। খুব ভালমতোই ও জানে ক্যানসার কাকে বলে আর এই অসুখের পরিণতি কী। তাই বলে ওকে বিমর্ষ ভাববেন না। মনমরা ভাববেন না। কারণ ও তো অস্কার! সক্কলের চাইতে ও আলাদা।
এই সময়ের ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান মুখ এরিক ইম্যান্যুয়েল শ্মিট তাঁর ২০০২-এর উপন্যাস ‘অস্কার অ্যান্ড দ্য লেডি ইন পিঙ্ক’-এ এমনই এক বালক আর ম্যামিরোজ নামের এক পরিণত বয়স্কা মহিলার সম্পর্কের ছবি তুলে এনেছিলেন, যার তুলনা বিশ্ব সাহিত্যেই বিরল। পরে শ্মিট নিজেই এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করেন। অসামান্য সেই ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এক বিরল রসের স্বাদ পেয়েছেন। অস্কারের কাহিনি ফিল্ম ছাড়াও মঞ্চে অভিনীত হয়েছে একাধিক জায়গায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় এই মর্মছোঁয়া নাটককে আগে দেখা যায়নি। লন্ডনের বাংলা নাট্যদল ‘মুকুল অ্যান্ড দ্য ঘেটো টাইগার্স’-এর উপস্থাপনায় কলকাতা দেখতে পেল সেই বিরল নাটক।
তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে রবিবার দর্শক সংখ্যা মেরে কেটে কুড়ি জন। সেই পরিমণ্ডলেই মুকুল আহমেদ উপস্থাপন করলেন ‘অস্কার অ্যান্ড দ্য লেডি ইন পিঙ্ক’। দশ বছরের অসুস্থ অস্কারের সদাসঙ্গী ম্যামিরোজ। ম্যামিরোজ সেই মহিলাদের একজন, যারা হাসপাতালের বাচ্চাদের সঙ্গ দেয়। গোলাপি পোশাকে তাদের আলাদা করে চেনা যায়। অস্কারের কাছে ম্যামিরোজ কিন্তু নিছক ‘লেডি ইন পিঙ্ক’ নয়। সে এক আশ্চর্য নারী। সে নাকি কারাতে জানে। সে নাকি ঘায়েল করেছে বিস্তর প্রতিদ্বন্দ্বীকে। অস্কার যে পুরোটা বিশ্বাস করে এমনও নয়। কিন্তু ম্যামিরোজ তাকে কারাতে-র গল্প শুনিয়েই যায়। বাবা-মা তার কাছে আসে না। সে জানে, বাবা-মা তাকে ভয় পায়। ম্যামিরোজ তাকে বোঝায়, তাকে নয়, তার অসুখকেই বাবা-মা ভয় পায়। অস্কারের তর্ক— তার অসুখটা তো তারই অসুখ। অসুখটা বাদ দিয়ে সে তো নেই। তা হলে?
এমনই আশ্চর্য উপলব্ধি এ নাটকের প্রায় প্রতিটি সংলাপে। এক সময়ে অস্কার জানতে পারে তার আয়ু আর ১২ দিন মাত্র। সে ভেঙে পড়ে। কিন্তু ম্যামিরোজ তাকে বোঝায়, তার এক দিন মানে অন্য লোকের ১০ বছর। তার ১২ দিন আসলে ১২০ বছর। সে যেন ঈশ্বরকে চিঠি লিখে জানায় তার প্রতি দিনের ঘটনা। ঈশ্বরের কাছে সে দিনে একটা বর চাইতেই পারে। অস্কার রাজি হয়। অস্কারের জীবনের বাকি ১২ দিন নিয়েই এই নাটক। কী ঘটে সেই ১২ দিনে, তা এখানে আলোচ্য নয়। কেবল এটুকু বলা দরকার, অস্কারের জীবনের শেষ ১২ দিন পরিণত হয় ১২০ বছরে। জীবনের সব ক’টি ধাপ পেরিয়ে সে তার ঈশ্বরের কাছে চলে যায়। সত্যি বলতে, ম্যামিরোজ আর অস্কারের এই কাহিনিকে অল্প কথায় বর্ণনা করাও অনুচিত। প্রতিটি সংলাপে, আলো-আঁধারির দোলাচলে, দমচাপা সঙ্গীতের অনবদ্য প্রয়োগে এ নাটক এক বিরল প্রযোজনা।
যে জায়গায় থমকাতেই হয়, সেটা এই প্রযোজনার অবিনয়। অস্কারের ভূমিকায় আতিক রহমান এবং ম্যামিরোজ ও পেগি ব্লু-র ভূমিকায় সঙ্গীতা চৌধুরী এতটাই দক্ষতার অভিজ্ঞান রেখেছেন যে, তাকে ‘অভিনয়’ বললে ছোট করা হবে। ডাঃ ডুসেলডর্ফের ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় শামিম ভিস্তিও নজর কেড়েছেন। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই নাটকের ডিজাইন। স্টেজ, লাইটস, সাউন্ড— সব মিলিয়ে এক আন্ডারটোন কামালের উদাহরণ রেখেছেন পরিচালক মুকুল আহমেদ। তাঁকে ধন্যবাদ। নাকি তার চাইতেও বেশি কিছু প্রাপ্য তাঁর?
কলকাতার কাছে একটাই প্রশ্ন। একটু বড় পরিসরে একটু বেশি দর্শককে আমন্ত্রণ জানিয়ে কি আয়োজন করা যেত না এই নাটকের? হাওড়া জোনাকি সাধ্যাতীত করেছেন। তার পরের দায়টুকু থেকে যায় শহরের নাট্যামোদীদেরই।