কল্পনার শুরু হয়েছিল সেই টিকিট কাটার সময় থেকে। মনের দেওয়ালে তৈরি হয়ে গিয়েছিল সিঁধ কাটার মত ছোট এক গর্ত। টিকিট কনফার্ম হবার পর থেকেই বড় হয়ে উঠতে লাগল সেই গর্তটা। আর সেখান দিয়েই ঢুকে পড়েছিল পাহাড়ি মেঘেরা। ক্রমে ক্রমে মনের দেউলে বদলে যেতে লাগল কলকাতার পথঘাট সব কিছু। মনে হলো আমি যেন হেঁটে চলেছি সেই পাহাড়ি ঝরনার ডাকে। শুনতে পাচ্ছি তার উচ্ছ্বল কলকল ধ্বনি।
এই সংক্রান্ত আরও ছবি জেখার জন্য CLICK করুন এখানে
সিকিমের সিমফোকে কিছুটা সময়
সাজিয়ে রাখা লাগেজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কাঁধে ওঠার। সত্যি বটে, ট্রেন জার্নির মত আনন্দময় ভ্রমণ আর কেউ দিতে পারে না। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে উত্তরবঙ্গ, সঙ্গে আমিও।
উৎসাহের বশে ভোর পাঁচটাতেই জাগিয়ে দিল সে। কিষাণগঞ্জ। এখন শুধু জানলা দিয়ে চুপচাপ চেয়ে থাকা। ঘরবাড়ি-গাছপালা, ছোট ছোট গ্রাম সবই লুকিয়ে পড়ছে গতির আড়ালে। পাশ দিয়ে দু’জোড়া রেল লাইন মাঝে মাঝেই ছেলেখেলা করছে। জুড়ে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে, আবার খুলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমার গাড়ির নিচে লুকিয়ে পড়ছে এবং পরক্ষণেই বেরিয়ে পড়ে হাসছে। এই নির্জীব রেললাইনের জীবন্ত নক্সা তৈরির খেলা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম এনজেপি-তে। এবার বোলেরোর পেটে ঢুকে চলো যাযাবর, যেখানে ছুটেছে মন।
জায়গাটার নামই ‘উত্তরে’। সিংগলিলা রেঞ্জ। এখান থেকেই ট্রেকাররা ফালুট, সানদাকফু, নেপাল বর্ডার ইত্যাদি জায়গায় ট্রেকিং করেন। কালুকে দু’দিন থেকে রিন চেং পং, ডেন্টাম ভ্যালি হয়ে এখানে এসেছি।
ভীষণ ঠান্ডা। মাঝে মাঝে আবার বৃষ্টি জড়িয়ে ধরছে। সাত-আট ডিগ্রি। ঢোকার মুখেই আছে কৃত্রিম টাইটানিক জাহাজ, ভেতরে ঢুকলে মনে হবে জাহাজটা চলছে। পশ্চিম সিকিমের এই জায়গায় না থাকলে সিমফোক যাওয়া সম্ভব নয়। আর গ্রিন ভ্যালির মত হোটেল না পেলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ। প্রাকৃতিক শোভা দেখার জন্যে হোটেল থেকে বাইরে যাবার দরকার হয় না।
সদা হাস্যমুখ, পেলিং-এর স্কুলশিক্ষক শের বাহাদুর সুব্বা হলেন হোটেল মালিক। অতিথিদের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা। চব্বিশ ঘণ্টা গরম জল, নিচেই কিচেন কাম ডাইনিং প্লেস। চারপাশ অপূর্ব সাজানো।
অনেক বাঙালি পরিবার এসেছেন। এক একটা টেবিল অধিকার করে বসে খাচ্ছেন, ছড়াচ্ছেনও। হই হট্টগোল, মোবাইলে বাজচ্ছে গান, প্রতি মিনিটে সেলফি উঠছে। নানান পারিবারিক কথাবার্তায় নির্ভেজাল বাঙালিয়ানার বিজ্ঞাপন দিয়ে টেবিল খালি করছেন।
হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়েছিল পাহাড়ি মেঘের দল, লজ্জায় জিভ কেটে বেরিয়ে গেল চেয়ার টেবিলগুলোর অবস্থা দেখে। আমার শিক্ষিত জাতভাইরা সভ্যতার উলঙ্গ রূপটি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
‘উত্তরে’ প্রবেশের মুখেই সেই বিশালাকার টাইটানিক। ছবি: চিত্তরঞ্জন দত্ত
দূর! আমি এ সব দেখছি কেন! এখানে তো আমি পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা নিতে আসিনি। এসেছি বাদল মেঘের আদর নিতে। কান পেতে শুনি ওরা কি ফিসফিস করে। টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া পথ সাপের মত এঁকেবেকে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে। ওখানে হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। পুরো রাস্তাটি পাথর বসানো। কখনও ঢালু হয়ে নেমে মিশে গেছে অজানা ঝরনার সঙ্গে। এখানে মুখ গোমড়া করে থাকেন দিবাকর দিনের বেশিরভাগ সময়ে। মাঝে মাঝে হেসে ওঠেন। আর তখনই হাসে রঙিন প্রজাপতির দল।
দু’দিকের উঁচু পাহাড় সবুজ সুন্দর। নীল আকাশকে প্রায় ঢেকে রেখেছে। দু’চারটে বাড়ি নিয়ে কিছু বসতি ঢাকা পড়ছে মেঘের আড়ালে, পরক্ষণেই সরে যাচ্ছে মেঘেরা। স্লাইড শো চলছে যেন অনবরত। অনেক উঁচুতে বৌদ্ধ গোম্ফা, যেখানে রঙের বাহারে চোখ আটকে যায়।
নেপাল বর্ডারের দিকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ গেলেই সিমফোক। বিএসএফ ক্যাম্পের পাশ দিয়ে সোজা পথ চলে গিয়েছে। হাঁটা পথ যে এত সুখের হতে পারে জানা ছিল না। এখানে ট্রাউট মাছের চাষ হয়। এটাও একটা দেখার মত স্পট। ছোট-বড় নানা সাইজের চৌবাচ্চা, মাছও নানা সাইজের। ঝরনার জল একদিক দিয়ে ঢোকে আর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। অনেকেই হয়ত জানেন না, জলের ওই স্রোত কিছুক্ষণ বন্ধ থাকলে মাছগুলোর মৃত্যু অনিবার্য। আর জল থেকে তুললেও মাছ জ্যান্ত থাকে না।
তবে, ট্রাউট মাছ আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় মানুষও এর নাগাল পান না, আকাশছোঁয়া দামের জন্য। পুরোটাই সিলপ্যাক হয়ে বিদেশে চালান হয়। হিমাচলের জিসপা নদী থেকে কিছু মাছ ওঠে। ওই সব জায়গা থেকে ট্যুরিস্টরা স্বাদ পেতে পারেন।
“আপ বাঙ্গালি হ্যায়”? জনৈক ট্যুরিস্ট জানতে চাইলেন। পরিচয় না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম, “আপ”? আলাপ হল সুরেশ লিম্বুর সঙ্গে। কালুকে কর্মরত পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া ব্যাক্তিটি, দশেরা মানাতে যাচ্ছেন শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে ভায়রাভাই। আমাদের বিজয়া দশমীর মতো ওঁরাও দীপাবলির দিন পর্যন্ত দশেরা পালন করেন।
“কোথায় আপনার শ্বশুরবাড়ি”? আঙ্গুল তুলে দেখালেন “বেলি গাঁওমে”। ষাট ডিগ্রি ঘাড় উঁচু করে দেখলাম— মেঘে ঢাকা স্বর্গপুরী যেন। আহা! ওখানে কিছুদিন থাকলে জীবন সার্থক হতো।
“কতক্ষণ লাগবে”? “দো ঘণ্টে”। অর্থাৎ, আমাদের হিসেবে চার ঘণ্টা।
হাতের ঝোলায় উপহার সামগ্রী। ফিটফাট, কপালে টিক্কা লাগানো লিম্বুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওদের মুখের হাসিতে ধরা পড়ে সুখের জলছবি। কত সুখী ওরা! জিজ্ঞেস করা হয়নি, ভারত ডিজিটাল হয়েছে সে খবর ওরা রাখে কি না!
মেঘের গন্ধ নাকে আসতেই মনে হল, ফিরতে হবে। এই পথ দিয়ে আমি সারাদিন হেঁটে যেতে পারি ক্লান্তিহীনভাবে। তবু ফিরে এলাম উত্তরে-তে। এখানে প্রকৃতির তুলি কখনও থেমে থাকে না। প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে ক্যানভাস। জলরঙের মাঝে মাঝে প্যাস্টেলের শেড পড়ছে। এটা শহর, না ভ্যানগগের আঁকা ছবি বোঝার আগেই ফেরার গাড়ি ধরলাম। যাযাবর থেমে থাকে না, চলে সে নিরন্তর পথের নেশায়।
বিঃদ্রঃ এনজেপি থেকে গাড়ি ভাড়া করে উত্তরে পৌঁছতে হয়। ভাড়া ৬০০০ টাকা। উত্তরে থেকে পায়ে হেঁটে আড়াই কিলোমিটার গেলেই সিমফোক।