না, সেই সময়ে ‘কামিং-অফ-এজ’ শব্দবন্ধটি আমাদের কারওরই জানা ছিল না। আমরা জানতাম— আর্ট ফিল্ম, কমার্শিয়াল ফিল্ম। পাড়ার চায়ের দোকানের ফিল্মি আলোচনায় একটা কথা প্রায়শই ঘুরপাক খেত, যার সারমর্ম এই— তেলে জলে যেমন মিশ খায় না, আদা দিয়ে যেমন কাঁচকলা রান্না করা যায় না, সাপ আর নেউলের যেমন বিয়ে হতে পারে না, তেমনই আর্ট ফিল্ম আর কমার্শিয়াল ফিল্মেও কোনও সমঝোতা সম্ভব নয়। সম্ভবত, বাঙালিই একমাত্র জাত, যে একথা প্রথম ভেবেছিল। ঘনঘোর ’৭০ দশক তখন। গুদামঘরের দরজা বন্ধ করে ঠোঁটের এক কোণ থেকে অন্য কোণে জিভ দিয়ে বিড়ি ঠেলে দিয়ে অমিতাভ বেধড়ক ক্যালাচ্ছেন ভিলেনদের, রাজেশ খন্নার ম্যানার্ড মেলেড্রামা দেখে বৌদি-কাকিমারা ফিদা, নেঞ্চুর সেলুনে কানচাপ্পি বচ্চনকাট কাটার জন্য হেব্বি লাইন। সেই আভাতিবেলায় কয়েকজন পরিচালক হিন্দি ফিলিম ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন কিছু করতে চাইলেন। না, সেই সময়ে বৌদি, কাকিমা, নেঞ্চু ওতার ক্লায়েন্ট— কারওরই ধারণা ছিল না সেই সব ‘নতুন ছবি’ সম্পর্কে। ১৯৭১-এই মনি কাউল তাঁর ‘উসকি রোটি’ করে ফেলেছেন। ১৯৭২-এ কুমার সাহনি ‘মায়া দর্পণ’ তুলে ঋত্বিক ঘরানার একটা দরজা খুলে রাখলেন। চায়ের দোকান, নেঞ্চুর সেলুন সে সব খবর রাখেনি। কিন্তু তলায় তলায় কিছু একটা ঘনিয়ে উঠছিলই।
সেই ঘনিয়ে ওঠাটা টের পেতে পেতে পাবলিকের ১৯৮০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। না, তখনও ‘কামিং-অফ-এজ’ শব্দবন্ধটা বাজারে জিও সিম-এর মতো ড্রপ খায়নি। একটু এগিয়ে থাকা কেউ বড়জোর ‘প্যারালাল সিনেমা’ কথাটা জুড়ে দিয়েছিলেন। আর তাতেই আমাদের রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিলেন কয়েকজন গ্ল্যামারহীন, ভাণহীন, বাগাড়ম্বরহীন মানুষ। তাঁদের কেউ ল্যাংপ্যাঙে রোগা তো কারও মুখে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার পাথুরে আবহবিকার। কিন্তু তাঁদের এই ঢুকে পড়াটাই বাঙালির সিনেমা-অভ্যাসকে আদ্যোপান্ত বদলে দেয়। তাঁরা কেউ অনুকরণযোগ্য আইকন হননি, হতেও চাননি। তাঁদের বাচনভঙ্গি নকল করে কেউ বাজার গরম করতে পারেনি, কারণ, তাঁদের কোনও ফিক্সড বাচনভঙ্গিই ছিল না। ম্যানারিজমহীন অভিনেতা বলে বর্ণনা করা যাবে না তাঁদের, তাঁরা বস্তুত অভিনয়হীন অভিনেতা।
বাঁধ ভাঙার সেই দিন
এই ঘরানার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ছিলই। ছবি বিশ্বাস বা পাহাড়ি সান্যাল অথবা ছায়া দেবীকে বোম্বাই ছবির ফ্রেমে খুঁজে পেতে যে ক’জন সংখ্যালঘু সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নাসিরউদ্দিন শাহ আর ওম পুরীই মুখ্য। আজ যখন ওম পুরীর শূন্যতার উপরে এই মুসাবিদা চলছে, তখন বার বার মনে পড়ছে ওম-নাসির জুটির অসম্ভব সব অভিনয়ের কথা। ‘জানে ভি দো ইয়ারো’-তে নাসির যদি বাঘ মেরে থাকেন, তবে আহুজারূপী ওম সিংহ মেরেছিলেন। সে যাই হোক, ওঁরা তখনও চায়ের দোকান বা সেলুনের বিষয় হননি। ভারতীয় অন্যধারার ছবির আয়রনিটা এখানেই যে, তা রিয়্যালিজম নিয়ে যত বাড়াবাড়ি করেছে, ততই তা পার্লারের মধ্যে আটকা পড়েছে, স্ট্রিট তাকে গ্রহণ করেনি।
এখানেই কি ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলেন ওম-নাসির? নাসির এক সময়ে তুলোধোনা করেন তথাকথিত প্যারালাল মুভির জগৎকে। তখন তিনি ‘ত্রিদেব’ করছেন। কিন্তু ওম নীরবে ভেঙে দিলেন তাঁর ইমেজ। ১৯৮২ সাল। বি.সুভাষ পরিচালিত ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ নিয়ে বাজার থরোথরো। নারায়ণী হলের নিম অন্ধকারে পর্দা কাঁপিয়ে মিঠুন ‘এ ও আ’ করছেন যখন, ঠিক তখনই সেখানে ওমের আবির্ভাব আমাদের মগজে কারফিউ লাগিয়ে দেয়। নাসিরের অনেক আগেই খাঁচা ভাঙেন ওম। নীরবে ভাঙেন। কারণ তিনি আর যাই হন, ‘অ্যালবার্ট পিন্টো’ ছিলেন না। ‘রাগী যুবক’-এর প্যারালাল ইনডেক্স তিনি নির্মাণ করেননি।
চিরবন্ধু: ওম ও নাসির
গোবিন্দ নিহালনির মতো পরিচালককেও খাঁচা ভাঙতে সময় নিতে হয়েছিল। ওমকে হয়নি। কারণ প্রথম থেকেই তিনি ‘আন অ্যাজিউমিং’। কোনও মুদ্রাদোষ নেই, কেবল ভারী পাথরের মতো গলা আর জীবনানন্দের ভাষায় ‘কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক’ দিয়েই তিনি কামাল করেছিলেন। নাসির-ওমের জুটিতেও তিনি কখনওই প্রথম পুরুষ নন। অথচ নাসিরের আত্মজীবনী ‘অ্যান্ড দেন ওয়ান ডে: আ মেমোয়্যার’-এর পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে যে কাহিনিগুলো, তা পড়তে বসলেই বোঝা যায়, ওম নিজে থেকে দ্বিতীয় না-হলে না হলে নাসির প্রথম হতেন না।
‘চাচি ৪২০’: কমল হাসানের সঙ্গে
তা হলে ওম কি আন্ডার অ্যাক্টিংয়ে বিশ্বাস রাখতেন? স্ক্রিনে ও জীবনে তাঁর ভূমিকা তো সেই রকম কথাই বলে। না, কোনও ‘আর্ট ফিল্ম’ নয়, খোলামনে দেখে ফেলুন ‘চাচি ৪২০’-এর বনোয়া-কে। নিরভিনয় শব্দটাকে মূর্ত করতে কী কাণ্ডই না ঘটিয়েছেন ওম! ‘অর্ধ সত্য’ থেকে ‘চাচী ৪২০’-কে কি কোনও ‘জার্নি’ বলা যায়? নাকি হিসেবে আনতে হবে, ওম-অভিনীত ভিনদেশি ছবিগুলিকেও? তাহলে ব্যাপারটা আরও ঘাঁটবে। ঘাঁটতে বাধ্য। কারণ বার বার তাঁর অভিনয় দেখতে বসে মনে হয়, তিনি ঘাঁটছেন, ঘেঁটে দিচ্ছেন দর্শকের অভ্যেসকে। এই বিশ্বায়িত বলিউডেও ওম সাবলীলভাবে তাঁর প্যারালাল ইনডেক্সকে বজায় রেখেছিলেন। অনায়াসে রেখেছিলেন। ডেফিনিটলি তাতে বিস্তর কেতার মিশেল ছিল। কিন্তু ওমের মতো অভিনেতা জানতেন, কেতাকেও কী করে নিরভিনয়ের মোড়কে পেশ করা যায়।
১৯৮০-র বৌদি-কাকিমারা আর্থারাইটিসে ক্যাঁক-ক্যোঁক করেন, নেঞ্চুর সেলুনে আর সিনেমার দর্শকরা যায় না। মোবাইলবাজ, সেলফি-আসক্ত, আত্মনেপদে আমাথানখ ডুবে থাকা মিলেনিয়ালরা কি ওমকে চিনতেন? ওমের প্রয়াণের পরে কেন জানি না একটা রাগ ঘনাচ্ছে মাথার ভিতরে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ফেসবুকে ওমের ছবির নীচে ‘রিপ’ লিখলে আর কাঁদুনে ইমোটিকন সাঁটলে বেধড়ক পেটাব। কোনও ভাণকেই প্রশ্রয় দেননি ওম। সোশ্যাল মিডিয়াও ভাণহীন থাকুক তাঁর প্রয়াণে।
ভাল থাকুন ওম। অন্তত ১৯৮০-র দশকে কৈশোর-যৌবন পেরনো প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে যেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন।