ধারাবাহিক মানেই কূটকচালি। তার সঙ্গে আছে বিভিন্ন পারিবারিক সমস্যা। তবে প্রধান হচ্ছে খলনায়ক! প্রতিটি সিরিয়ালেই দেখা যাবে, একটা সুখী পরিবারের গল্প দিয়ে শুরু। বেশ চলছে। হঠাৎ আগমন ঘটবে কোনও খলনায়ক বা নায়িকার। ব্যস! তার পরেই দুঃখ-অশান্তিতে ভরে উঠবে গল্প। এতদিন ধরে দর্শক এগুলোই দেখে আসছেন এবং উপভোগও করছেন। এই ধরনের ধারাবাহিকের ঢলও নেমেছে তেমন। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা শুরু! কিন্তু ইদানীং বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। গতে বাঁধা ধাঁচ বাদ দিয়ে ‘পটলকুমার গানওয়ালা’, ‘দুগ্গা দুগ্গা’, ‘বেদেনি মলুয়ার কথা’র মতো ধারাবাহিক হচ্ছে। আগে যে কয়েকটা অন্য বিষয় নিয়ে টেলিভিশনের গল্প লেখা হতো, সেগুলো পিছিয়ে পড়ত পারিবারিক গল্পগুলোর কাছে। ‘মা’, ‘ইষ্টি কুটুম’, ‘রাগে-অনুরাগে’র মতো ফ্যামিলি ড্রামার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি ছিল।
তবে এখন উল্টো পুরাণ! অন্য জঁরের ধারাবাহিকগুলোই বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এমনকী, এই ধরনের ধারাবাহিক বানানোর প্রবণতাও বাড়ছে পরিচালকদের মধ্যে! ক্রমান্বয়ে মুক্তি পাচ্ছে অন্য জঁরের ধারাবাহিক।
বাংলা ধারাবাহিক ‘ভুতু’।
আধ্যাত্মিকতার প্রবণতা
ফ্যামিলি ড্রামা থেকে সরে এসে এই জাতীয় ধারাবাহিকের প্রবণতা হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়েছে। আধ্যাত্মিক বিষয়ে সিরিয়াল আগে হয়নি, এমনটা নয়। ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’র মতো ধারাবাহিক অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। কিন্তু কোথাও যেন, আর পাঁচটা ফ্যামিলি ড্রামার চাপে পিছিয়ে পড়ত। যে কোনও চ্যানেলে মূলত বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে ধারাবাহিকগুলো। সকালে আবার থাকে তারই রিপিট টেলিকাস্ট। সিরিয়ালগুলোর টার্গেট দর্শক বরাবরই মধ্যবয়সি গৃহবধূ। সুতরাং সেই বুঝেই সন্ধেটা বেছে নেওয়া। সাধারণত আধ্যাত্মিক বিষয়ক ধারাবাহিক টেলিকাস্ট হতো দুপুরের দিকে। প্রাইম টাইমে কিন্তু সেই ফ্যামিলি ড্রামাই। কিন্তু এখন সন্ধের সময়েই থাকছে এগুলো। রীতিমতো টেক্কা দিচ্ছে গতানুগতিকতাকে। ‘দুর্গা’, ‘এসো মা লক্ষ্মী’, ‘ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’এর মতো ধারাবাহিক একের পর এক দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। যেগুলোর জনপ্রিয়তা ফ্যামিলি ড্রামাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জি বাংলা চ্যানেলের বিজনেস হেড সম্রাট ঘোষ বললেন, ‘‘দর্শকের কাছে নতুন কিছু নিয়ে আসতে চাইছি। তাঁরা অন্য কিছু চাইছেন। আর আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। একঘেয়েমি যাতে না থাকে, তার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের ধারাবাহিক নিয়ে আসা হচ্ছে। আমরা এখন মাথায় রাখছি, সব বয়সের দর্শকই যেন পছন্দ করেন ধারাবাহিকগুলো। কোনও নির্দিষ্ট বয়সের দর্শককে টার্গেট করে কাজ করি না।’’
পুরনো গল্পের প্রাচুর্য
নব্বইয়ের দশকে পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে অনেক ধারাবাহিকই হয়েছে। এমনকী, তখন এই ধারাবাহিকগুলোর জনপ্রিয়তাই ছিল শীর্ষে। কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন টেলিভিশনে প্রায় কোনও নামগন্ধ ছিল না পৌরাণিক গল্পের। এখন আবার ফিরে এসেছে ‘সীতা’, ‘মহাভারত’। তার সঙ্গে আবার দেখা যাচ্ছে ‘কিরণমালা’র মতো রূপকথার গল্পও। অন্যদিকে আবার ওপার বাংলার লোকসাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে ‘বেদেনি মলুয়ার কথা’র মতো ধারাবাহিক। দর্শক অনেক বেশি উপভোগও করছেন এই ধারাবাহিকগুলো। পুরনো কালের গল্পের উপর মানুষের একটা আগ্রহ থাকেই। কিন্তু এই যুগের দর্শকরাও যে রূপকথার গল্প বা পৌরাণিক কাহিনি জানায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন, এটা আশ্চর্যের বটে! শুধু তাই নয়, ধারাবাহিকের ব্যাপারে যাঁরা চিরকাল নাক সিঁটকেছেন, তাঁরাও এখন সময় করে বা কাজের ফাঁকে দেখে নিচ্ছেন এই সব ধারাবাহিক। সুতরাং ট্রেন্ড চালু হওয়ার পিছনে দশর্কের চাহিদাও যে কাজ করছে কিছুটা, তা
বলতেই হয়।
ফ্যামিলি ড্রামা অ-প্রধান
আরেক ধরনের ‘অফবিট’ ধারাবাহিক শুরু হয়েছে ইদানীং। যেখানে মুখ্য বিষয় কখনও ছোটদের গল্প, কখনও আবার গোয়েন্দা গল্প। কিন্তু তাতে পরোক্ষভাবে হলেও ঢুকে পড়েছে ফ্যামিলি ড্রামা। তা সত্ত্বেও তা আর পাঁচটা ‘টিপিক্যাল’ ফ্যামিলি ড্রামার চেয়ে আলাদা। কারণ দু’টো। এক, সেখানে মুখ্যভূমিকায় থাকছে অন্য বিষয়, যাকে পারিপার্শ্বিক দিক থেকেই শুধু সহায়তা করছে পরিবারের গল্প। দুই, যে ফ্যামিলি ড্রামা দেখানো হচ্ছে সেগুলোও অনেক সহজ-সরল, কোনও জটিলতায় যাওয়া হচ্ছে না। স্ক্রিপ্ট রাইটার সাহানার কথায়, ‘‘একই রকমের কাজ করতে গিয়ে আমরাও বোর হয়ে গিয়েছি। তাই নতুন কিছু করতে চাই সব সময়। চিন্তা ছিল দর্শক কীভাবে নেবেন? কিন্তু এখন দেখছি দর্শকের কাছ থেকে ভালই প্রতিক্রিয়া আসছে। এটা একটা ‘মিথে’ পরিণত হয়েছে, যে দর্শক ফ্যামিলি ড্রামাকে বাদ দিয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করবেন না। কিন্তু সেটা যে ভুল, তা দর্শকই প্রমাণ করেছেন।’’ একই কথা বলছেন পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। তাঁর প্রযোজিত দু’টি ধারাবাহিক ‘দুগ্গা দুগ্গা’ ও ‘বেদেনি মলুয়ার কথা’ আলাদা জঁরের। রাজের কথায়, ‘‘দর্শককে নতুন কিছু দিতে হবে। আমার অন্তত সব সময় সেই চেষ্টাই থাকে। তবে এটাও ঠিক, দর্শক টিপিক্যাল ফ্যামিলি ড্রামাও পছন্দ করেন। যেহেতু সেই ছকটা তাঁদের চেনা। তাই কী হতে পারে, না পারে সেটা বুঝতে পারেন খানিকটা। সেই কারণে স্বচ্ছন্দও হন। তবে দেখা যাচ্ছে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তাঁরা পছন্দ করছেন।’’
উল্টো পুরাণের কারণ • সময় অনুযায়ী দর্শকের রুচির পরিবর্তন। • নতুন কিছু করার প্রয়াস। • সব বয়সের দর্শকই আগ্রহ দেখাচ্ছেন এই ধরনের ধারাবাহিকগুলোর প্রতি। • চাহিদা বাড়ার জন্য প্রযোজকেরা ব্যবসার কথা মাথায় রেখেই নতুন জঁরের ধারাবাহিক নিয়ে আসছেন। |