ওয়াক কলকাতা, ওয়াক!
হাঁটো কলকাতা, হাঁটো! হাঁটলেই জানা যাবে ইতিহাসের কথা, জানা যাবে অনেক হারিয়ে যাওয়া গল্প! কিন্তু সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে এমন এক ব্যাক্তিকে, যিনি গল্পের ছলে গড়গড় করে বলে যাবেন শহরের ইতিউতি লুকিয়ে থাকা নানা কথা।
এমন হেঁটে হেঁটে শহর চেনার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হেরিটেজ ওয়াক’। এবং সম্প্রতি এই প্রফেশনে আসছেন অনেকেই। ছোট ছোট গ্রুপ নিয়ে তাঁরা কলকাতার অলিগলিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জানা-অজানা কত কথাই না জানিয়ে দেন এই হেরিটেজ ওয়াকের দৌলতে।
তেমনই এক হেরিটেজ ওয়াকের আয়োজন ছিল বুধবার। বুদ্ধ পূর্ণিমা মাথায় রেখেই শহরের তিনটি বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ঘুরিয়ে দেখান অভিজিৎ ধর চৌধুরী। খুব সুন্দর একটি নামও দিয়েছিলেন এই পথচলার— ‘বুদ্ধ ট্রায়াঙ্গল’। এই ত্রিকোণ ওয়াকের তিন গন্তব্য ছিল যথাক্রমে ‘মায়ানমার বৌদ্ধ মন্দির’, ‘বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা’ ও ‘মহাবোধি সোসাইটি’।
কলকাতার সি আর অ্যাভিনিউ-এর বৌদ্ধ মন্দির। ছবি: শেলী মিত্র
মহাবোধি সোসাইটি-র নাম ও স্থান সম্পর্কে বেশিরভাগ কলকাতাবাসীই জানেন। কলেজ স্কোয়ারের এই বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নিয়ে না হয় পরে কখনও চর্চা করা যাবে। বো ব্যারাক অঞ্চলে বৌবাজার থানার পিছন দিকেই রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থায় রয়েছে দাতব্য চিকিৎসালয়, স্কুল ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার ব্যবস্থা। রয়েছে একটি সভাঘরও। যেখানে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে গতকাল বক্তব্য রাখেন মহাবোধি সোসাইটির প্রধান-সহ অনেকেই।
কিন্তু, এ সব কিছুই ছাপিয়ে গিয়েছিল ‘বুদ্ধ ট্রায়াঙ্গেল’-এর প্রথম স্থানটি। সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন থেকে বেরোলে রানা প্রতাপের মূর্তি রয়েছে। সেটি পেরোলে ডানদিকে রয়েছে ইডেন হসপিটাল রোড। সেন্ট্রাল এভিনিউ থেকে ওই রাস্তায় ঢুকলেই বাঁদিকের দ্বিতীয় বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে ওই বাড়িতে কোনও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে।
পুরনো দিনের তিনতলা বাড়ি। তাই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে দম বেরিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় তলায় উঠলেই সামনের একটি ঘরে রয়েছে বুদ্ধের আসন। ফ্লোরের বাকি ঘরগুলিতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভেতরের দিকে রয়েছে রান্নাঘর ও ডাইনিং হল। দেখলে মনে হবে, হস্টেলের পরিবেশ।
বিন্নি চালের হালুয়া। ছবি: শেলী মিত্র
প্রচুর রজনীগন্ধা দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো বুদ্ধমূর্তি। বিকেল পাঁচটা হবে। মূর্তির সামনে মাটিতে বসে রয়েছেন মন্দিরের প্রধান ‘পুরোহিত’। তাঁকে ঘিরে বসে রয়েছে জনা সাতেক ‘স্টুডেন্ট’। তারা এখানে কয়েক দিন থেকে, চলে যাবে সারনাথ।
মনের মধ্যে প্রচুর প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু, কেউই কথা বলছেন না। কারণ বাংলা, ইংরেজি বা হিন্দি, কোনও কিছুই তাঁরা বোঝেন না। তখনই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ভানু সেন। ছোট্টখাট্ট রোগা মানুষটি সুন্দর বাংলা বলেন। যদিও একটা ‘টান’ রয়েছে তাঁর কথনে। ষাট ছুঁই ছুঁই ভদ্রলোক এ শহরে রয়েছেন প্রায় ৩০ বছর। জানালেন, তাঁর জন্ম-পড়াশোনা সবই তৎকালীন বর্মায়। অর্থাৎ, মায়ানমারেই কেটেছে তাঁর জীবনের প্রথম ৩০টি বছর। হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তিনি বৌদ্ধ মন্দিরে কেন রয়েছেন জানতে চাওয়ায়, তিনি বললেন— ‘অভ্যাস’।
মায়ানমারে প্রচলিত রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মই। এবং সেখানের মানুষ বুদ্ধকে, ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসেবেই দেখেন। তাই সেদেশের ঘরে ঘরে বুদ্ধ মূর্তির পাশে বিরাজমান থাকেন লক্ষ্মীও, জানালেন ভানু সেন। তিনি আরও জানান, মন্দিরের প্রধান পুরোহিত যেহেতু কোনও ভাষাই বলতে পারেন না, তাই দিনের বেশির ভাগ সময়েই তিনি এখানে থাকেন। যদিও পাশেই রয়েছে তাঁর নিজস্ব ব্যবসা।
অতিথিদের আপ্যায়নের কোনও ত্রুটিই রাখলেন না ভানু সেন। মায়ানমারের স্পেশাল কফির সঙ্গে আড্ডাটা বেশ জমে গিয়েছিল। সঙ্গে বুদ্ধ পূর্ণিমার ‘ভোগ’— বিন্নি ধান চাল থেকে তৈরি হালুয়া। কথিত, তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে সুজাতা এই হালুয়া খাইয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধকে।
মাঝে রয়েছেন ‘টিচার’। তাঁকে ঘিরে শিক্ষার্থীরা। ছবি: শেলী মিত্র
আড্ডার মাঝেই বেশ কিছু তথ্য দিলেন ভানু সেন। তিনি জানান, ১৯২৮ সালে এই বাড়িটি ৪৭ হাজার টাকায় কিনে এই বৌদ্ধ মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। যে বুদ্ধ মূর্তিটি এখানে পুজিত হয়, তা মায়ানমার থেকেই আনা। এখানে বুদ্ধ ‘ভূমিস্পর্শ’ মুদ্রায় বিরাজমান। অর্থাৎ, তাঁর ডান হাত ভূমি স্পর্শ করে রেখেছে। এমনিতে বোঝা না গেলেও, মূর্তিটির পাঁচটি অংশ রয়েছে। মাথা, দুই হাত ও দুই পা শ্বেত পাথরের তৈরি, এবং তা দেহ থেকে আলাদা করা যায়। মূর্তির দেহ কাঠের তৈরি। ভানু সেন জানান, এমন মূর্তি মোট পাঁচটি তৈরি করা হয়েছিল। দু’টি এখনও রয়েছে মায়ানমারে। তবে, বাকি দু’টির কোনও সন্ধান নেই।
প্রচুর তথ্য মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘ট্রায়াঙ্গেল’-এর দ্বিতীয় কোণের উদ্দেশ্যে।