প্রতিবাদের ভাষা ঠিক কেমন হওয়া উচিত তা তর্কসাপেক্ষ এবং বিবিধ স্থান-কাল-পাত্র সাপেক্ষ তো বটেই। কিন্তু প্রতিবাদই শেষ কথা এবং কোনও বিজ্ঞাপনী ভণিতা ছাড়া শুদ্ধ প্রতিবাদ উঠে আসবে সিনেমায়, এমনটাই কাম্য। কলকাতা ফিল্মোৎসবের পঞ্চম দিনে প্রদর্শিত দু’টি ছবি ‘সিবেল’ ও ‘দ্য থার্ড ওয়াইফ’ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে এক নিঃশব্দ দৃঢ়তায়।
দু’টি ছবিই ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। জি জিওভানেত্তি ও কাগলা জেনসারকির দ্বৈত পরিচালনায় ‘সিবেল’-এ উঠে আসে সাম্প্রতিক তুরস্কের গ্রামাঞ্চল যেখানে খাবার ঘর থেকে ক্ষেতখামারে, চোখ রাঙায় পুরুষ-নারীর বহমান ‘স্টেটাস কুয়ো’। আর সেখানেই নারীসুলভ পোশাকি আচরণগুলি ঝেড়ে ফেলে ‘রেবেল’ হয়ে ওঠে সিবেল। বাকশক্তিহীন সিবেলের শিস যতটা তীক্ষ্ণ, ততটাই তীব্র তার শব্দহীন প্রতিবাদের ভাষা। প্রেমিকের চেহারায় বড় আদরে যেন জেহাদকেই লালন করে সে। সেই প্রেম যেন তাকে নিঃশব্দে বলে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাও, পুরুষতন্ত্রের নেকড়ের দিকে তাক করো বন্দুক, লজ্জিত হোক সেই সমাজ যে সমাজে অনর কিলিং কোনও কলঙ্ক নয়।
‘সিবেল’ ছবির একটি দৃশ্য়ে অভিনেত্রী ডামলা সোনমেজ। ছবি: সিনেমার সোশ্যাল মিডিয়া পেজ থেকে
ছবির এই প্রতিবাদী ভাষারই যেন শরীরী নির্মাণ ঘটে ডামলা সোনমেজের রক্ত টগবগানো অভিনয়ে। চোখ থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তিনি ‘রেবেল’ হয়ে ওঠেন কী অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ত তীব্রতায়! সিনেম্যাটিক ট্রিটমেন্ট থেকে অভিনয়— এই তীব্রতা বড় আশ্চর্যজনক ভাবে ‘বিরল’ গাঙ্গেয় উপত্যকার নিম্নগতিতে, সমসময়ের ৯৯ শতাংশ সিনেমায়! অতিরিক্ত প্রাকৃতিক আর্দ্রতাই কি এর জন্য দায়ী?
‘সিবেল’ যদি প্রতিবাদের একাল হয়, তবে সেকাল হল ‘দ্য থার্ড ওয়াইফ’। ফেস্টিভ্যাল শিডিউলে এই দু’টি ছবির স্ক্রিনিং পর পর রাখার কারণও হয়তো তাই। আবার সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গোয়েজের নিরিখেও অ্যাশ মেফেয়ার পরিচালিত এই ছবি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। শুরু থেকে শেষ, প্রত্যেকটি ন্যানোসেকেন্ডেও এ ছবি অসম্ভব নান্দনিক, ইমপ্রেশনিস্ট!
‘দ্য থার্ড ওয়াইফ’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সিনেমার ফেসবুক পেজ থেকে
প্রতিবাদ এখানে শান্ত নদীর মতো, যেন ছুঁয়ে থাকে, ঘিরে থাকে আদরে। সে প্রতিবাদ কখনও প্রেমহীন বৈবাহিক যৌনতার যন্ত্রণা ভুলে স্বমেহনের আনন্দ, কখনও তা নিষিদ্ধ প্রেম মতোই অপ্রতিরোধ্য। চল্লিশোর্ধ্ব জমিদারের বহুগামী ঘরকন্নায় প্রতিবাদ সিঁধ কাটে গুপ্ত পিতৃত্বে। কিন্তু পুরুষতন্ত্রকে এ ছবি নস্যাৎ করে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। সভ্যতায় সভ্যতায় আদিঅনন্তকাল ধরে, ভ্রুণহত্যা-নির্যাতন-বঞ্চনা পেরিয়ে, মায়েরা যেমন যত্নে লালন করে মেয়েদের— এ ছবি বলে, ওটাই ‘প্রতিবাদ’!
পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপেই, তার নাকের ডগায়, চুপচাপ বেড়ে উঠুক নারীত্বের স্বয়ংসিদ্ধ অ্যান্টিথিসিস! বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক !