সে অনাথ, তাকে হাসপাতালেই ফেলে গিয়েছিল কেউ। তার পর তার ঠাঁই হয় সিঁড়ির নীচে। সেখানেই বিন্দাস থেকে যায় জগ্গা নামের সেই ওয়ান্ডার বয়, যাকে সামনে রেখে রচিত হয় আখ্যান, যা শোনে কিছু বাচ্চা ভিড় করে। এই ভাবেই ‘জগ্গা জাসুস’ নামের ছবিটির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন পরিচালক অনুরাগ বসু। জগ্গা রিয়াল নাকি মিথ, সে কি কোনও কমিক বুক হিরো— একথা ছবি শেষ হওয়ার পরেও স্পষ্ট হয় না। স্পষ্ট করেনইনি পরিচালক। আর সেটা করার দরকারও নেই। কারণ, ‘জগ্গা জাসুস’ এমনই এক কিসিমের ছবি, যেখানে ‘বাস্তব’ আর ‘না-বাস্তব’ চলে সমান্তরাল রেল লাইনের মতো। জগ্গার কাহিনিতে স্কুল বাচ্চা আর তাদের দিদিমণির বাস্তবতার সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে থাকে জগ্গা আর শ্রুতি সেনগুপ্তর অ্যাডভেঞ্চার। যেখানে পরতে পরতে মিশে থাকে অসংখ্য ‘রেফারেন্স’। দেখতে বসে মনে হয়, ‘জগ্গা জাসুস’ কি একটা কোনও ছবি? নাকি বেশ কিছু পুরনো ছবির একটা কোলাজ? থুড়ি, কোলাজ বলাটা একেবারেই ঠিক নয় এই ‘মিউজিক্যাল’-কে। বরং একে বলা যায় ‘পাশতিশ’, যার আভিধানিক অর্থ— ‘এমন এক শিল্পকর্ম, যা অন্য শিল্প, শিল্পী অথবা স্মৃতিকে মনে পড়িয়ে দেয়’। আক্ষরিক অর্থেই ‘জগ্গা জাসুস’ মনে পড়ায় একরাশ দিশি-বিলিতি সিনেমাকে। যারা হয়তো ভারতীয় গণস্মৃতির পলিমাটির উপরে পাকাপোক্ত শিলালেখ হয়ে বিরাজ করছে। এই প্রতিবেদনে সেই স্মৃতিরেখাগুলিকেই একবার দেখার চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে একথাও জানানো জরুরি যে, এই প্রতিবেদন মোটেই এই ছবির সমালোচনা নয়। তেমন কোনও উদ্দেশ্যই এর নেই।
‘জগ্গা জাসুস’-এর পোস্টার থেকে
ছবির সিকোয়েন্স ধরেই দেখা যেতে পারে এই ছবির ‘পাশতিশ’ চরিত্রকে।
• ছবি শুরুই হচ্ছে পুরুলিয়ার প্রান্তরে একটি শ্যুটিং-দৃশ্য দিয়ে। খাঁ খাঁ টাঁড়ের উপরে একদল ছৌ-মুখোশ পরা নর্তক সারিবদ্ধ ভাবে নেচে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে ‘ফুলগাছটি লাগাইছিলম’ ঝুমুরটি। চেনা দৃশ্য। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘উত্তরা’ (২০০১)। নীচে রইল ওই সিকোয়েন্সের স্টিল। বুদ্ধদেব বাবুর ছবিতে এই নাচ ছিল ‘ডান্স অফ ডেথ’। দূরে নায়িকা উত্তরার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সৎকারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু, ‘জগ্গা জাসুস’-এ ব্যাপারটা ছবির সূত্রপাত। এই মুহূর্তেই শুরু হয় আকাশ থেকে অস্ত্রবর্ষণ। কিন্তু সমস্যা এখানেই। পুরুলিয়ায় অস্ত্রবর্ষণ হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। আর বুদ্ধদেববাবুর ‘উত্তরা’ মুক্তি পেয়েছিল ২০০১-এ। ১৯৯৩-এ বুদ্ধদেব তুলেছেন ‘চরাচর’, ১৯৯৭-এ ‘লাল দরজা’। ১৯৯৫ ব্ল্যাঙ্ক। এর পরের ছবি ‘উত্তরা’। কিন্তু ‘জগ্গা জাসুস’-এ কি ইচ্ছে করেই গুলিয়ে দেওয়া হল সময়ের সত্যিকে?
‘উত্তরা’ ছবির সেই দৃশ্য। ছবি: ইউটিউব
• জগ্গা অনাথ। তাকে মানুষ করে হাসপাতালের নার্স-ডাক্তাররা। তার ঠাঁই হয় সিঁড়ির নীচের একটা ঘরে। মনে পড়তে বাধ্য আর এক অনাথ ওয়ান্ডার বয়ের কথা। তার ঠিকানা— দ্য কাবার্ড আন্ডার দ্য স্টেয়ার্স। ৪, প্রাইভেট ড্রাইভ। লিটল হুইংগিং। সারে। ইউকে।
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সোরসারার্স স্টোন’, ছবি: ইউটিউব
হ্যারি পটার। সিঁড়ির নীচের কুঠুরি থেকে বিশ্বজয়ের গপ্পো এসে বসে ‘জগ্গা জাসুস-এর চিত্রনাট্যেও।
হগওয়ার্টস-এর ব্যাঙ্কোয়েট, ছবি: ইউটিউব
• কেবল ঠিকানা নয়। হ্যারি পটার আরও একটা জায়গায় জগ্গার উপরে ছায়া ফেলে। জগ্গার স্কুল। বাংলার পাহাড়ের ইস্কুল বাড়িটি পাথুরে, গথিক স্থাপত্যের। ল্যাবিরিন্থ-সমৃদ্ধ এই বাড়ির অলিগিলিতে আলো-আঁধারির জাফরি-সৌন্দর্য। গোয়েন্দা গল্পের উপযুক্ততম পরিবেশ। কীভাবে যেন মনে পড়ে যায় হ্যারিদের জাদু-ইস্কুল হগওয়ার্টস-এর কথা। গথিক কেল্লা হগওয়ার্টস হ্যারি-কাহিনির প্রধান জায়গা জুড়েই রয়েছে। ‘জগ্গা জাসুস’-এ তেমনটা নয়। কেবল ওই আলো-ছায়া দোলা স্মৃতিকে উসকায়।
জগ্গার স্কুল, ছবি: ট্রেলার থেকে
• জগ্গার সিগনেচার এক বিশেষ হেয়ার স্টাইল। এক পাশে খাড়া হয়ে থাকা একগোছা চুল। ছবিতে যাকে জগ্গার ‘অ্যান্টেনা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিছুদিন আগে একগাদা ওয়েব সাইট ‘জগ্গা জাসুস’-এর ট্রেলার দেখেই ‘টিনটিন টিনটিন’ করে শোর মচাতে শুরু করেছিল। কিন্তু কারওরই মনে পড়েনি আর এক গোয়েন্দা এস ভেঞ্চুরার কথা। জিম ক্যারি অভিনীত হলিউড কমেডি ‘এস ভেঞ্চুরা: পেট ডিটেকটিভ’ (১৯৯৪) এবং ‘এস ভেঞ্চুরা: হোয়েন নেচার কলস’ (১৯৯৫)-এ জিম ক্যারির সেই উদ্ভট চুল-কেতা কে ভুলতে পারে? ভেঞ্চুরা অনেকটা গোয়েন্দা খানিকটা ভাঁড়। জগ্গা ভাঁড় নয় বটে, সে সিরিয়াসও তো নয়! খালি ভেঞ্চুরা হারিয়ে যাওয়া পোষ্যের সন্ধান করে আর জগ্গার প্রেমিসেস খুন-চোরাচালান-অপহরণ।
‘এস ভেঞ্চুরা’, জিম ক্যারি, ছবি: পোস্টার থেকে
• এইখান থেকেই মনে পড়তে পারে শ্রীস্বপনকুমার রচিত ড্রাগন সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ-এর গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জীর কথা। যার শ্যাম্পুরুক্ষ চুল বাতাসে উড়ত আর সেই উড়ুক্কু চুল ছুঁয়ে বেরিয়ে যেত দুশমনের ছোড়া বুলেট। জগ্গার চুলের উড়ুক্কু সাইড-ঝুঁটি কি সেই স্ল্যাশার নভেলের প্রতি একটা ট্রিবিউট? নামগোত্রহীন স্বপনকুমারের জগৎকে এর আগে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ (২০১৫) ছবিতে ঘনিয়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। দিবাকর শরদিন্দুর জগতের চাইতে অনেক বেশি করে তুলে এনেছিলেন স্বপনকুমারের চায়নাটাউন, চোরাচালান ও খুনের বিশ্বকে। পিছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। গ্লোবাল যড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করছেন ব্যোমকেশ বক্সী। ভিলেন অনুকূল ডাক্তার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল। তার ‘ক্যাচ’গুলিও ইন্টারন্যাশনাল। জগ্গাও ঘটনাচক্রে প্রবেশ করে আন্তর্জাতিক ক্রাইম এরিনায়। ‘জগ্গা জাসুস’ তার মিউজিক্যাল চরিত্র নিয়ে প্রবেশ করে ‘স্ল্যাশার মুভি’র আঙিনায়।
ট্রেলারে আর একবার দেখুন জগ্গাকে
• অবধারিত ভাবে এসে পড়েন সত্যজিৎ রায়। ছবির সংলাপে জগ্গার মুখেই ফেলুদা আর শার্লক হোমসের কথা রয়েছে। কিন্তু স্বয়ং জগ্গাকেই কিনা অবতীর্ণ হতে হল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর সিকোয়েন্সে? নাইফ থ্রোইং দুর্ধর্ষ দুশমন মগনলাল মেঘরাজের বেজায় পছন্দের। তাই খামোখা রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যসিক জটায়ুকেই দাঁড়াতে হয় নাইফ থ্রোয়ারের সামনে। একই স্কোয়েন্স ‘জগ্গা জাসুস’-এও। মনে পড়বেই ফেলুদা-ভক্তদের।
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ছুরি ছোড়ার দৃশ্য, ছবি: ইউটিউব থেকে
• সত্যজিৎ শুধু এখানেই নন। উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিৎ ছড়িয়ে রয়েছেন আরও অনেক জায়গাতেই। বাবা ‘টুটি ফুটি’-কে খুঁজতে জগ্গা পাড়ি দেয় আফ্রিকান দেশ মোম্বাকায়। ‘বোম্বাগড়’-এর সঙ্গে ধ্বনিগত মিল পাচ্ছেন? তা হলে জানুন, এখানেই শেষ নয়। ‘হোটেল আগাপাশতলা’ কি ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’-র রণন নয়? ‘গোমড়াথেরিয়াম’, ‘বেচারাথেরিয়াম’, ‘চন্দ্রখাই’? সুকুমারীয় লজিকের উত্তরাধিকার এসে মেশে উপেন্দ্রকিশোরে। বাবাকে খুঁজতে জগ্গা পৌঁছয় শুন্ডি। একেবারেই ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ ঝাঁপ। কিন্তু অনুরাগের শুন্ডি কেমন দেশ? সেটা একটা মরুপ্রায় অঞ্চল। সাভানা ঘাসের দঙ্গল পেরলে খাঁ খাঁ মরুর মধ্যে দিয়ে ছুটে যায় রেলগাড়ি। কয়লার ইঞ্জিনের রেল। উট নয় উটপাখি চেপে সেদিকে ধেয়ে যাওয়া। রামদেওরা মনে পড়ে? ‘সোনার কেল্লা’! না। এর বেশি কিছু বলব না।
‘পথের পাঁচালী’-র সেই বিখ্যাত দৃশ্য। ছবি: ইউটিউব থেকে
• সাভানার দঙ্গল পেরচ্ছে দুই নারী পুরুষ। দূরে রেলগাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে মাঝের পাড়া স্টেশনের ডিস্ট্যান্ট সিগন্যাল না শুন্ডির এক ঝিমঝিমে রেলস্টপ। সাভানার দঙ্গল যদি শরতের কাশবন হয়ে যায়, ক্যামেরায় জগ্গা আর শ্রুতি নয়, অপু আর দুর্গা নামের দুই চিরন্তন কৈশোর এসে বসে, তা হলে? তলিয়ে দেখলে ‘জগ্গা জাসুস’ কখন যেন ‘ট্রিবিউট টু রায়’ হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না।
হেনরি ও ইন্ডিয়ানা জোনস, ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’, ছবি: ইউটিউব থেকে
• শেষ পর্ষন্ত ‘জগ্গা জাসুস’ এক বাবা-ছেলের আখ্যান। প্রফেসর বাগচি আর জগ্গা রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ না হলেও, তারা বাবা ও ছেলে তো বটেই। হারিয়ে যাওয়া, ‘মৃত’ হিসেবে ঘোষিত আর এক বাবার কথা কি মনে পড়বে না! হেনরি জোনস। প্রত্নতত্ত্বের অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক আবিশ্ব দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন ১৯৮৯ সালে। স্টিভেন স্পিলবার্গের ক্ল্যাসিক অ্যাডভেঞ্চার মুভি ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’-এ বাবা শন কোনরি আর তুখোর লায়েক ছেলে হ্যারিসন ফোর্ডকে কী করে ভুলবেন মুভি বাফ-রা? বার বার উঁকি দিয়েছে ইন্ডিয়ানা জোনস সিরিজ। মোম্বাকার পরতে পরতে তিনটি ইন্ডিয়ানা জোনস ছবির উঁকিঝুঁকি। উটপাখির রেস থেকে চেজ সিকোয়েন্সের প্রায় সর্বত্র, এমনকী নেতাজির পদাঙ্করেখায় পৌঁছনো গুপ্ত গুহাপথের আনাচে-কানাচে ইন্ডিয়ানা জোনস। টু-সিটার উড়োজাহাজ, সার্কাসের জন্তুবাহী রেলগাড়ি থেকে শুরু করে বাবা ও ছেলের শেষ দৃশ্যে ভিলেন চূড়ামণি বশির আলেকজান্ডারের হাতে বন্দি হওয়ার দৃশ্যটিতে পর্যন্ত ছায়া ফেলেন স্পিলবার্গ। এটা যদি ট্রিবিউট টু সত্যজিৎ হয়, একই সঙ্গে এ ছবি ট্রিবিউট টু স্পিলবার্গও।
‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’, মনে পড়ে কি ‘জগ্গা জাসুস’-এর লাস্ট শট? ছবি: ইউটিউব
• ডিজনি পরিবেশিত এই ছবিতে উঁকি দিয়েছে ‘লায়ন কিং’ (১৯৯৪)। সাভানা-আফ্রিকার সূর্যাস্তের সিল্যুট আবার ব্যবহৃত হয় এখানে। এটাও উদ্ধৃতি। একে কখনওই ‘টুকলি বলা যাবে না।
‘লায়ন কিং’-এ সূর্যাস্ত, ছবি: ইউটিউব
আর নয়। ‘পাশতিশ’ খুঁজতে খুঁজতে বেলা বইয়ে দিলাম। আসলে এটা না বললেই নয় যে, পাশতিশ-এর এই ব্যবহার ভারতীয় ছবিতে বিরল। অ্যাস্টেরিক্স-এর পাতায়, উমবের্তো একোর উপন্যাসে, হোর্হে লুইস বোর্হেসের ছোটগল্পে ব্যবহৃত হয় পাশতিশ। অনুরাগ কি পথপ্রদর্শন করলেন? হয়তো নয়। পাশতিশের প্রয়োগ যে কোনও শিল্পেই ঘটতে পারে। ঘটেও। কিন্তু সচেতন ভাবে একটা গোটা ছবিকে শুধু পাশতিশ দিয়ে সাজানো— এটা বোধ হয় এই প্রথম ঘটল ভারতীয় সিনেমায়। বাজারে খবর, ‘জগ্গা জাসুস’ নাকি তেমন চলছে না। গোঁসা করছেন রণবীর কপূরও নানা ওজর তুলে। তা হলে কি আম দর্শকের কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল এত যত্নে তোলা একটা আশ্চর্য ছবি। আফশোস করে আর ক্লেদ বাড়াব না।