ময়দান। তারা মুখোমুখি বসে। মেয়েটির থুতনির উপরে হাত। কোথাও চিন্তার মেঘ। মেয়েটি বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছে। এমন এক মুহূর্তে, ছেলেটি সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে পারে না। আচমকাই ছেলেটি জানায় দূরদেশ সিরিয়ায় সে এক নির্মাণ সংস্থায় চাকরি পেয়েছে। মেয়েটি কি যাবে অত দূর?
উত্তর সাবলীল। মেয়েটি জানায়, তার সঙ্গে সে যে কোনও জায়গায় যেতে রাজি।
এক হিন্দু মেয়ে এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আসলে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন তারা দেখছিল। জীবন সুন্দরই ছিল, সিরিয়ায় তাদের একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়। কিন্তু এখানেই ছেদ। মেয়েটিকে ফিরে আসতে হয় কলকাতায়। কোলে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শিশুকন্যা আর মস্তিষ্কে সিরিয়ার যুদ্ধে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা। অচৈতন্য মেয়েটির সেবা, জীবনধারণের জন্য কঠোর সংগ্রাম আর দামাস্কাসের ভারতীয় দূতাবাসে স্বামীর খোঁজে হন্যে হয়ে খোঁজ— এই হয়ে দাঁড়ায় তার সারাদিনের কাজ।
‘ভালবাসার শহর’ আসলে এক দীর্ঘ অপেক্ষার ছবি। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে, বুকে বিরহের এক তীব্র দাগকে এক অচেনা দেশের মানচিত্রের মতো বইতে বইতে মেয়েটি ক্লান্ত হয়, তার পায়ের নীচের অন্ধকার মাটি ঘোরে, সে জানে মাঝরাতে বিড়ালেরা কেন শিশুর মতো কণ্ঠে ডুকরে ওঠে।
আকাশ ধোঁয়ায় ভারী হয়ে থাকে। ওখানে ঈশ্বর নেই। অন্ধকার তাকে একলা পেয়ে গলা টিপে ধরে, শ্বাসরোধ হয়ে আসে তার। বাড়িতে মেয়েটির বাবাও অসহায়। তিনিও জানেন না এই প্রতীক্ষার অবসান কোথায়। বৃদ্ধ অচৈতন্য শিশুটির যত্ন নেন যতক্ষণ মেয়েটি বাড়ির বাইরে থাকে। জীবন এরকমই, শূন্য থেকে জন্ম, আবার সন্তানের জন্ম দেওয়া, কিছুটা নরকযন্ত্রণা ও তার পরে আবার শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া। এর মধ্যেই হয়তো এক চিলতে আলোর মতো আশা টিকে থাকে। যদি ফিরে আসে তার স্বামী, যদি চোখ মেলে উঠে বসে বাচ্চাটি।
অস্তিত্ব আহামরি কিছু নয়। প্রেম হয়তো স্বর্গীয়। কিন্তু ‘ভালবাসার শহর’ ছবিটি দেখার পরে ঠিক কী অর্থ এসবের উপর আরোপিত হবে, জানা নেই। দিশাহীন এই পৃথিবী কিছু অর্থহীন ভাববাদী শক্তির ক্রীড়ামাত্র নয়। দূরে, যুদ্ধে অথবা না-যুদ্ধে যে শিশুরা মারা যাচ্ছে, তাদের ঈশ্বর মারছেন না। ভাগ্য তাদের মৃতদেহগুলিকে শেয়াল-কুকুরের মুখের সামনে তুলে ধরে না। এ দায় আমাদের, একান্ত ভাবেই আমাদের। আমাদের ভিতরে চলা নিরন্তর যুদ্ধের।
‘ফড়িং’-এর সাফল্যের পরে ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর এই ছবি আসলে এক উচ্ছিন্ন পরিবারের টিকে থাকার সংগ্রামের কাহিনি। যুদ্ধ এখানে এক আতঙ্করেখা দিয়ে গণ্ডি কেটে দেয় সেই পরিবারটির চারপাশে। ছবিটি দেখতে গিয়ে মনে হয় এই ট্র্যাজেডি থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোক করা যায়, সেই শোক কিছুটা মৃতের জন্য আর বাকিটা আত্মনের ধ্বংসের জন্য। কিন্তু নিরন্তর শোকের প্রবাহের কথা আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের প্রাচীন জ্ঞান সমর্থন করে না। শোক তো কোনও কিছুকে বদলাতে পারে না। শোক হারিয়ে যাওয়া কোনও কিছুকেই ফিরিয়ে দেয় না। যা হারিয়ে গিয়েছে, তা হারিয়েই গিয়েছে। শূন্যতার মধ্যে কয়েকটা আঁচড় থেকে যায় মাত্র।
ক্লাসে পড়াতে পড়াতে একথা বলেইছি, তেমন দিন বেশি দূরে নয়, যখন আমাদের সিনেমা হলে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। সিনেমাই নিজে থেকে আমাদের কাছে আসবে। সেইদিন এসে গিয়েছে। ‘ভালবাসার শহর’ নিজে থেকেই এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। ছবির ওপেনিং শটটি যেন দর্শককে উদ্দেশ্য করে খুলে দেয় ছবির ভুবন। কোথাও নিজের দিকে দর্শকের চোখ টানার চেষ্টা নেই। শুরুতে পরিচালক দর্শকের সামনে এক প্রস্তাব রেখেছেন— যদি ছবি ভাল লাগে, আমাদের অর্থ-সাহায্য করুন। যদি না লাগে, তাহলে কিন্তু আমরা ভেঙে পড়ব না।
এটা যেন একটা হারজিতের ডিল। ইউটিউবে ছবিটি দেখতে পয়সা লাগে না। তাহলে পরিচালক কী পান? তাঁর প্রাপ্তি তো দর্শকের চিন্তা আর তার সংহতির উপর নির্ভরশীল। আমার বিশ্বাস, এমন ছবি সেই সংহতিকে আরও দৃঢ় করে দেয়। পরিচালকেরা এমন এক নতুন প্ল্যাটফর্মে যেখান থেকে জয়ও হতে পারে, পরাজয়ও ঘটতে পারে। টাকা আসে তো ভাল, যদি না আসে, ভিউয়ারশিপের পরিসংখ্যান তা পুষিয়ে দেবে। কতজন মানুষ ছবিটিকে ভালবেসেছেন তা জানতে অন্যত্র দৌড়তে হবে না।
আমি যখন ছবিটি ইউটিউবে দেখেছি, তখন ভিউয়ার সংখ্যা ১২৭৪২৩ এবং তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। এবেলা.ইন এমন একটি প্রকল্পকে নিয়ে আসতে যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছে। শুভেচ্ছা রইল তাদের জন্য।
(লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন বিভাগের ফ্যাকাল্টি-সদস্য ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের অতিরিক্ত অধ্যাপক। বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির কলেজ ও ইসরো, আমদাবাদের অতিথি অধ্যাপক)