শেষ কবে হিন্দিতে পুরোপুরি ছোটদের জন্য একটা ছবি হয়েছিল, মনে পড়ছে কি? আর মিউজিক্যাল তো ছেড়েই দিন। ছোটদের ছবিতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে কিছু বড়রা। আর মিউজিক্যালের নামে হয়েছে লারেলাপ্পা। অভিযোগটা এবার আর করা যাবে না। করতে ইচ্ছেই করবে না! ‘জগ্গা জাসুস’ এমন একটা ছবি, যাতে শৈশব আছে, সম্পর্ক আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সততা আছে।
ছবিটা কী নিয়ে, কী রয়েছে তাতে, ট্রেলার দেখে সত্যি কিছু বোঝা যায়নি। তবে আন্দাজ করা গিয়েছিল, পরতে পরতে একটা শৈশব থাকবে। ধোঁকা দেননি অনুরাগ বসু। যা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আসল জায়গাতেও সেটাই দেখিয়েছেন। ‘বরফি’র পর থেকে যে দীর্ঘ অপেক্ষা তিনি করিয়েছেন, ছবিটা দেখে মনে হল সেটা সার্থক। তবে সেই ছবিতে যে চার্লি চ্যাপলিনের অনুপ্রেরণা নিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন, সেটা এখানে নেই। বরং অনুরাগ যেন নিজস্ব একটা ম্যানারিজম তৈরি করে ফেলেছেন। জগ্গা (রণবীর কপূর), টুটি-ফুটি ওরফে প্রোফেসর বাগচি (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) এবং শ্রুতির (ক্যাটরিনা কাইফ) মধ্যে।
জগ্গা জাসুসের সঙ্গে অনেকেই টিনটিনের তুলনা টেনেছিলেন। ছবিটা দেখলে আর টানবেন না। এই জগ্গা পুরোপুরি দিশি। বাঙালিও। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অস্ত্রপাচারের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন পরিচালক। ফিকশনাল জাসুস, অথচ ফ্যাকচুয়াল তার জাসুসি! আর ট্রিটমেন্ট পুরো ফ্যান্টাসি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনও সিরিয়াস হয়নি জগ্গা, টুটি ফুটি আর শ্রুতির গল্প।
ছবি শুরু হচ্ছে পুরুলিয়ায়। যেখানে ছৌ-নাচের শ্যুটিং করতে যায় প্রোফেসর বাগচির নেতৃত্বে একটা টিম। হঠাৎ লাইট রিফ্লেক্টরের ভুল সংকেতে বিদেশি কার্গো বিমান থেকে কার্পেট বম্বিং হয় অস্ত্রবোঝাই বাক্সের। যেটা পুরুলিয়া অস্ত্রবর্ষণের ঘটনা বলে সারা বিশ্বে খবর হয়েছিল ১৯৯৫ সালে। তার পরেই কাট। কলকাতা বইমেলা। জগ্গা জাসুসের কমিক্স বই সেখানে বিক্রি হচ্ছে অভিনব কায়দায়। জড়ো হওয়া খুদে পাঠকদের জগ্গার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনাচ্ছে আরেকদল খুদে। অভিনয় করে। গান গেয়ে। ময়নাগুড়ির হাসপাতালে ফেলে রেখে যাওয়া এক শিশু কীভাবে জগ্গা হয়ে উঠল, কীভাবে তার পালক পিতা প্রোফেসর বাগচিকে খুঁজে পেল সেই গল্প।
জগ্গার জীবনে শুরু থেকেই অ্যাডভেঞ্চার থাকত না, প্রোফেসর বাগচির সঙ্গে দেখা না হলে। সে এক অনবদ্য জুটি। টুটি টাঙ্গ অওর ফুটি কিসমত নিয়ে জগ্গার বাবা টুটি-ফুটি হয়ে উঠল বাগচি। কিন্তু একদিন জগ্গাকে চলে যেতে হল টুটি-ফুটিকে বোর্ডিং স্কুলে রেখে। কিন্তু আসতে থাকল প্রত্যেক বছর একটা করে ভিসিপি। টুটি-ফুটির বার্থডে মেসেজ। এদিকে জগ্গা হয়ে উঠছে দুঁদে গোয়েন্দা। পুলিশকে গান গেয়ে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনটা খুন, কোনটা নয়। কিন্তু ছোটখাটো কেস সল্ভ করতে করতেই বড় কেসে জড়িয়ে পড়ে সে। যেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় সাংবাদিক শ্রুতির। দু’জনে বেরিয়ে পড়ে টুটি-ফুটির খোঁজে।
পুরুলিয়া-কলকাতা-ময়নাগুড়ি-মণিপুরের উখরুল-মোম্বাকা, একে একে অ্যাডভেঞ্চার করতে করতে জগ্গা মিসিং লিঙ্ক খুঁজে পায় ওই অস্ত্রব্যবসায়ীদের। যারা কখনও সোমালিয়া, কখনও সিরিয়া, কখনও কাশ্মীরে যুদ্ধ লাগায়। অথচ এ রকম সব সিরিয়াস কথা অনুরাগ বলে গেলেন জগ্গার জার্নি দিয়েই। যে জগ্গা তোতলায় বলে ছন্দ করে কথা বলে। যে জগ্গা খুব একা, কিন্তু জীবনের স্পিরিটটা জানে।
ছবির সঙ্গে ‘ডিজনি’র নাম জড়িয়েছিল বলে বাড়তি একটা আগ্রহ ছিলই। রূপকথার গল্প বলার ক্যানভাস জুগিয়ে আসা ‘ডিজনি’। ‘জগ্গা জাসুস’ও তো রূপকথাই। কিন্তু ছবি আঁকতে গেলে যে মনের প্রয়োজন, সেটা না থাকলে হয় না। অনুরাগের সেই মনটাই তো প্রতিটা ফ্রেমে নানা রকমের ছবি এঁকে গেল। মণিপুরের ছোট্ট একটা জেলা উখরুলে যে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি আছে, সেটা ক’জন জানে? সেখানকার একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে যে আজাদ হিন্দ বাহিনী বর্মা থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল, তা-ই বা ক’জন বাঙালি জানে? জানলেও সেই ঘটনার সঙ্গে জগ্গার গোয়েন্দা-অভিযান জুড়ে দেওয়ার তারিফ না করে পারা যাচ্ছে না।
‘লা লা ল্যান্ড’ নিয়ে এত চিৎকার হল, অস্কার হল। এবার ওই একই কারণে ‘জগ্গা জাসুস’ নিয়ে হোক। অমিতাভ ভট্টাচার্য এবং প্রীতম মিলে যে কী কাজটা করে দিলেন! কথায় কথায় গান, গানে গানে কথা। ব্যালান্স করা মুখের কথা নয়। কী অনবদ্য রাইমিং ডায়ালগ! আর সিনেম্যাটোগ্রাফি? ডিওপি এস রবিবর্মন মোম্বাকার মরুপ্রান্তরেও যতটা দক্ষ, মোম্বাকা শহরেও ততটাই। বিশেষ করে উখরুলকে যেভাবে তাঁর ক্যামেরা তুলে ধরেছে, কুরনিশ! শুধু ছবির দ্বিতীয় ভাগটা একটু নড়বড়ে না হলে বোধহয় আরেকটু জমত। আর একটু ছোট হলেও।
রণবীর কপূরের তোতলামি কিন্তু ক্যারিকেচারিশ লাগেনি। ক্যাটরিনাকে ঠিক টিপিক্যাল সাইডকিক বলা চলে না। আর শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়? বব বিশ্বাসের দু’মিনিটেও তিনি যেমন, টুটি ফুটির অনেক বেশি মিনিটেও তিনিই সেরা। রজতাভ দত্ত পুলিশের ভূমিকায় যথাযথ। দশটা ফোনের মধ্যে কোনটায় আসলে রিং হচ্ছে, সে বুঝতেই পারে না! সৌরভ শুক্লও ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন যথারীতি।
অনুরাগ, আপনি ছুটি-ছুটি জমানায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। এখন অবশ্য ডিডি সেভেন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তবে ওই প্রজন্মটা ঘামায়। আর তারা খুশি, যে পরবর্তী প্রজন্মকেও কেউ শুন্ডি ঘুরিয়ে আনতে পারেন!