লা লা ল্যান্ড মানেই লস অ্যাঞ্জেলেস। লা লা ল্যান্ড মানেই হলিউড। আবার লা লা ল্যান্ড মানে এমন একটা জায়গা, যেখানে রোজ শ’য়ে শ’য়ে মানুষ আকাশকুসুম স্বপ্ন নিয়ে আসেন। হয়তো তাঁদের মধ্যে একজনের স্বপ্ন পূরণ হয়। বাকিরা হারিয়ে যান। কিন্তু এই ছবি তাঁদের নিয়ে নয়। আবার সফলদের নিয়েও নয়। এই ছবি স্বপ্ন দেখতে শেখা আর স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে। এখনকার সিনিক্যাল যুগে যেন আলতোভাবে মলম লাগিয়ে দেয় লা লা ল্যান্ড।
মিয়া (এমা স্টোন) একজন উঠতি অভিনেত্রী। যে দিনের পর দিন অডিশন দিয়ে যায়। ডাক পায় না কোথাও, কিন্তু হাল ছাড়ে না। সেবাস্টিয়ান (রায়ান গসলিং) জ্যাজের ভক্ত। পেশায় পিয়ানিস্ট। নিজের ক্লাব খোলার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যতদিন না সেটা হচ্ছে, তাকে রেস্তোরাঁয় ক্রিসমাস ক্যারল বা পার্টিতে খেলো গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজিয়েই রোজগার করতে হয়। দু’জনের বারবার দেখা হয়, ঝগড়া হয়, তারা প্রেমে পড়ে, চাঁদের আলোয় ‘সিঙ্গিং ইন দ্য রেন’এর মতো নাচগান করে, ছোট ছোট সাফল্যে লাফিয়ে ওঠে, আবার হতাশায় ভেঙেও পড়ে। তারা যত স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন দেখে, গল্পও তেমন এগোতে থাকে।
‘সিনেমার মৃত্যু’ নিয়ে হালে কম কথা হয় না। সেই ক্লাসিক হলিউডের মায়া নাকি এখন মৃত। মিউজিক্যালের মৃত্যু তো আরও আগে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই বিষণ্ণ সময়ে ‘লা লা ল্যান্ড’ আশার আলো দেখায়। শুরুর সিকোয়েন্সে ট্র্যাফিক জ্যামের মাঝে সকলকে নাচগান করতে দেখে দর্শকের ঠোঁটে একটা অনাবিল হাসি ফুটে উঠবেই। জ্যাজ ক্লাবের মেলানকলি, মিয়া-সেবাস্টিয়ানের রোমান্টিক মুহূর্ত, তাদের নাচের স্ফূর্তি, শিল্পীর একাকিত্ব— প্রতিটা পারফরম্যান্সে (কোনওটা শুধু গান, কোনওটা নাচও) দর্শককে সযত্নে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখবে এই ছবি। নতুন করে সিনেমার প্রেমে পড়তে বাধ্য করবে। হলিউডি আড়ম্বরকে ফের ভালবাসতে শেখাবে ‘লা লা ল্যান্ড’।
এই ছবির হাত ধরেই রায়ান গসলিং-এমা স্টোনের জুটি ‘আইকনিক’ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তাঁদের রসায়ন কেমন, তা আগে থেকেই জানেন দর্শক (এই নিয়ে তৃতীয় ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে)। দু’জনেই যেমন দক্ষ অভিনেতা, তেমনই অসাধারণ পারফর্মার। তবে আইকনিক ট্যাপ-ডান্সিং জুটি ফ্রেড অ্যাস্টায়ার-গিঞ্জার রজার্সের সঙ্গে তুলনা না টেনে তাঁদের এই যুগের মিউজিক্যালের জুটি হিসেবেই দেখা প্রয়োজন।
এটা এমন একটা যুগ, যখন মানুষ সিনেমা হল’এ আর যেতেই চান না। সারা পৃথিবী যখন অনলাইনে মুভি স্ট্রিমিং ওয়েবসাইট খুঁজতে ব্যস্ত, সেই সময় সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ফেললেন পরিচালক ড্যামিয়েন চ্যাজেল। দু’বছর আগে তাঁর অসাধারণ ডেবিউ ‘হুইপল্যাশ’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কখনওই ভুলবেন না। প্রথম ছবির মতোই এ ছবিরও মিউজিকের দায়িত্বে ছিলেন তাঁর পুরনো সহপাঠী এবং বন্ধু জাস্টিন হারউইট্জ।
পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের জনপ্রিয় হলিউড মিউজিক্যালগুলোর সঙ্গে এখন অনেকেই নিজেদের মেলাতে পারেন না। বাস্তববাদী সিনেমা দেখে দেখে চরিত্রেরা কথায় কথায় অমন নাচগান করে উঠছে, তা এ যুগের মানুষ খুব একটা মানতে পারেন না (ভারতীয় সিনেমাকে এ ক্ষেত্রে বাদ রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ)। কিন্তু চ্যাজেল এখানে গল্পের সঙ্গে গানগুলো এমন সুন্দরভাবে বুনেছেন যে, সেগুলো দেখতে অস্বাভাবিক লাগবে না। গ্র্যান্ড রোম্যান্স গল্প বললেও শেষ পর্যন্ত অনেক বেশি বাস্তববাদী চ্যাজেলের মিউজিক্যাল।
মিয়া-সেবাস্টিয়ানের সম্পর্কের মতোই ছবির গল্পেরও কিছু খামতি রয়েছে। কিন্তু বৃহত্তর স্পেক্টাক্লে সেগুলো চোখে পড়ে না। রোম্যান্সের সঙ্গে লস অ্যাঞ্জেলেসের বিভিন্ন আইকনিক ল্যান্ডমার্ক খুব সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক। তবে সিনেমার ইতিহাসের এক অন্যতম সেরা সিকোয়েন্স তিনি তৈরি করে ফেলেছেন এ ছবির শেষে। বাকি ছবিটা যদি মুগ্ধ করা হয়, তাহলে শেষটা দমবন্ধ করা!
চারিদিকে যখন মধ্যমেধার জয়জয়কার, তখন কিছুটা জোরের সঙ্গেই বলা যায় যে এ ধরনের ছবি অদূর ভবিষ্যতে আর সহজে দেখা যাবে না।