দিল্লি থেকে লন্ডন! একা হাতে গাড়ি চালিয়ে বিলেত পৌঁছেছিলেন তিনি। দিল্লি-নিবাসী নিধি তিওয়ারি। সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর দুই বন্ধু। রশ্মি কোপ্পার এবং সৌম্যা গোয়েল। ৯৫ দিনের সফরে তাঁরা পার হয়েছেন ১৭টি দেশ। তাঁদের গাড়ির মাইল-মিটার বলছে, গাড়ি চলেছিল মোট ২৩,৮০০ কিলোমিটার। কেমন ছিল তাঁদের লং-ড্রাইভের অভিজ্ঞতা?
এই রকম একটা ট্রিপের ভাবনা এল কীভাবে?
অ্যাডভেঞ্চার করতে আমি বরাবরই ভালবাসি। জন্মেছি বেঙ্গালুরুতে। সেখানে থাকার সময় থেকেই আমি অনেক ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। তখন থেকেই গাড়ি চালানোর নেশাটা আমাকে পেয়ে বসেছিল। ১৯৯৭ সালে বেঙ্গালুরু থেকে গাড়ি চালিয়ে লাদাখ গিয়েছি। ড্রাইভিংয়ের মধ্যে একটা স্বাধীনতার গন্ধ রয়েছে। গাড়ি চালিয়ে মাইলের পর মাইল চলে গেলে নিজেকে সবকিছু থেকে মুক্ত মনে হয়। গাড়ি চালিয়ে নতুন নতুন জায়গায় যাওয়াটা তো যে কোনও ড্রাইভারের কাছে স্বপ্নের মতো! লন্ডন ট্রিপের ভাবনাটা ২০১৫’র শুরুর দিকে আমার মাথায় এসেছিল। কিন্তু সফরের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও ছিল!
কী রকম সমস্যা?
দেখুন, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। তাই আর্থিক ব্যাপারটা তো ছিলই। প্রথম থেকেই জানতাম, যেভাবেই হোক একটা স্পনসর জোগাড় করতে হবে। প্রথমে এই সফরের কথাটা আমার পরিবার এবং বন্ধুদের বলি। তখনও পর্যন্ত একক ড্রাইভের পরিকল্পনাই করছিলাম। একদিন স্মিতা রাজারাম মজুমদার (বন্ধু) আমাকে বলেন, যেসব মহিলারা ড্রাইভ করতে ভালবাসেন, তাঁদের জন্য কিছু একটা করলে কেমন হয়! সেই থেকেই আমরা দু’জনে ‘উইমেন বিয়ন্ড বাউন্ডারিজ’ তৈরি করি। মহিলা ড্রাইভারদের উৎসাহ দেওয়া এবং মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে ‘উইমেন বিয়ন্ড বাউন্ডারিজ’ কাজ করে। যাই হোক, এসবের পাশাপাশি স্পনসরের খোঁজটাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
খোঁজ পেলেন?
স্পনসরশিপের প্রস্তাব নিয়ে অনেকের কাছে গিয়েছিলাম। ট্যুরের পরিকল্পনাটা অনেকেরই ভাল লেগেছিল। কিন্তু প্রত্যেকেই একটা জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছিলেন। আমি একা ট্যুরটা শেষ করব কীভাবে...!
একা মহিলা। ক্রস-কান্ট্রি সফর। পথের বিপদ। এই সব, তাই তো?
একদম! যে সংস্থা থেকে আমি প্রথম ভাল ফিডব্যাক পাই, সেটা হল ‘মাহিন্দ্রা ফার্স্টচয়েস হুইল্স’। তবে ওঁরা কিছুদিন সময় চেয়েছিলেন। তারপর ওঁরাই আমাকে ডেকে নেন। অন্যদের মতো তাঁরাও কয়েকটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। প্রথম, সফরটা আমি একা করব কীভাবে? এবং দ্বিতীয়, কোনও ব্যাক-আপ ভেহিক্যাল থাকবে না! সংস্থার কর্তাদের প্রশ্ন ছিল, ‘যদি খারাপ কিছু ঘটে যায়, তাহলে কে দায়ী থাকবে?’ আমিই ওঁদের একটা অপশন দিই। বলি, অন্য কেউ যদি সফরে যেতে আগ্রহী হোন তাহলে...? ওঁরা রাজি হয়ে যান। অন্যদিকে আমার নিজেরও মনে হয়েছিল, ভারত সরকারের সমর্থনটা প্রয়োজন। তাই বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। তাঁরাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ইতিমধ্যে আমার দুই বন্ধু সৌম্যা গোয়েল এবং রশ্মি কোপ্পারও সফরে যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর?
‘মাহিন্দ্রা...’র তরফ থেকে আমাকে ২০১৩ সালে তৈরি একটা স্কর্পিও দেওয়া হয়। ৬৪,৫০০ কিলোমিটার চলা ছিল গাড়িটির। কয়েক সপ্তাহের জন্য গাড়িটি আমার বাড়ির গ্যারাজে এনে রেখেছিলাম। প্রয়োজনীয় টুকিটাকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে, শেষমেশ ২০১৫’র জুলাই মাসে আমরা (নিধি, সৌম্যা এবং রশ্মি) ট্রিপটা শুরু করি।
দিল্লি থেকে লন্ডন। ড্রাইভার আপনি একা! সিদ্ধান্তটা একটু বেশিই ঝুঁকির ছিল না?
(হাসি) আরে, কীসের ঝুঁকি বলুন তো? ড্রাইভ করব বলেই তো প্ল্যানটা করেছিলাম। তবে আমাকে একটা বিষয়ের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। সহনশীলতার। সত্যি বলতে কী, এখনও অবধি যতগুলো ট্যুর করেছি, প্রত্যেকটাই এককভাবে। তাই একটা গাড়িতে অন্য দু’জনের সঙ্গে পথ চলার ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অন্য রকম ছিল। আর যদি রাস্তার ঝুঁকির কথা বলেন, তাহলে বলব— প্রতিদিন তো আমরা এত ধর্ষণের খবর পাই। সেই মহিলারা তো কোথাও ড্রাইভ করছিলেন না। তাহলে? অগর হামারে সাথ কুছ হোতা হ্যায়, তো উও কিসিকে সাথ ভি হো সকতা হ্যায়। কেউ যদি আমাদের জিনিসপত্র-গাড়ি চুরি করে, সেটা অন্য কারও সঙ্গেও হতে পারে! ইট্স অল অ্যাবাউট মাইন্ডসেট!
ভলগাগ্রাদ (রাশিয়া)
সড়ক পথে কোনও দেশে প্রবেশ করলে, ভিসা এবং রোড পারমিট পেতে একটু বেশিই ঝক্কি পোহাতে হয়। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
একদমই তাই! সড়ক পথে আপনি কোনও দেশে ঢুকলেন। আবার বেরিয়ে গেলেন। এবং সেই দেশের সরকার আপনাকে সফর সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সহজেই দিয়ে দিল— এমন দেশ প্রায় নেই। সড়ক পথে কেন সে দেশে প্রবেশ করছেন, সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েই আপনাকে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসা দেওয়া হয়। কোন রাস্তা দিয়ে যাবেন, সেটাও সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস অনেক সময় জানতে চায়। আসলে কী জানেন তো, কোনও দেশের ভিসা চাইলে সেটা দেওয়া হয় আপনার বিমানের টিকিট দেখে। কবে সে দেশে নামলেন এবং কবে দেশ ছাড়লেন। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল অন্য। আমরা বলতাম, হয়তো অমুক তারিখ আমরা আপনাদের দেশে ঢুকতে পারি। এবং সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এতদিন আমরা অমুক দেশে থাকব। এ ব্যাপারগুলো নিয়েই সমস্যা ছিল। তবে বিদেশমন্ত্রক আমাদের সাপোর্ট করায় অনেকটাই সুবিধা হয়েছে।
প্রথমে মায়ানমার। তারপর যথাক্রমে চিন, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স। সবশেষে ব্রিটেন। এটাই তো ছিল আপনাদের রুটম্যাপ?
(হাসি) হ্যাঁ!
লাটভিয়ার পথে।
ইউরোপে যেতে গেলে মধ্য এশিয়া হয়ে যেতে হবে। এবং মধ্য এশিয়ায় পৌঁছনোর দু’টো রাস্তা। এক, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান হয়ে। এবং দ্বিতীয়, চিন পেরিয়ে। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন আপনারা দ্বিতীয় রুটটি বেছেছিলেন। কেন?
প্রথমদিকে আমি নেপাল হয়ে চিন যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু ২০১৫’র এপ্রিলে নেপালের ভূমিকম্প সেই হিসেব বদলে দেয়।
আপনাদের সফরনামায় উজবেকিস্তানকে যোগ করার পিছনেও তো বিশেষ কারণ ছিল?
কারণটা মুঘল সাম্রাজ্যের স্রষ্টা সম্রাট বাবর। উজবেকিস্তান বাবরের পৈতৃক দেশ। ছোটবেলা থেকে বাবরের সম্পর্কে পড়ে আসছি। তাই উজবেকিস্তান যাওয়াটা ছিল পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। ও দেশের জীবনযাত্রাটা কেমন, সেটা দেখতে চেয়েছিলাম। যখন কারাকোরাম রেঞ্জে ড্রাইভ করছিলাম, ভাবছিলাম একটা সময় এখান দিয়েই বাবর ভারতে গিয়েছিলেন।
মস্কো
প্রত্যেক দেশের ট্রাফিক নিয়ম-কানুন তো আলাদা। মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি?
এটা ঠিক যে, প্রত্যেকটা দেশেই গাড়ি চালানোর নিয়মকানুন আলাদা। মায়ানমারের কথাই ধরুন। সেখানে সামনের গাড়িটি সিগন্যাল না দিলে আপনি ওভারটেক করতে পারবেন না। এটা কি আমরা দিল্লির রাস্তায় কল্পনা করতে পারি? আসলে কোনও দেশে প্রবেশ করে কত দ্রুত আপনি সেখানকার নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেবেন, সেটা আপনার উপরেই নির্ভর করবে। নতুন দেশে ঢুকে প্রথম ২০০ কিলোমিটার আপনাকে অন্যদের দেখে গাড়ি চালাতে হবে। এবং যত দ্রুত সম্ভব সেখানকার ট্রাফিক নিয়মগুলো বুঝে নিতে হবে।
আপনি যে গাড়িটি নিয়ে সফরে বেরিয়েছিলেন সেটা লেফ্ট হ্যান্ড ড্রাইভের উপযুক্ত। কিন্তু যে দেশগুলো আপনি পার হয়েছেন, সেগুলোর অধিকাংশেই রাইট হ্যান্ড ড্রাইভিং নিয়ম। কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
কিছুটা অসুবিধা তো হয়েইছে। সামনের গাড়িকে আপনি তখনই ওভারটেক করতে পারবেন, যখন সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখতে পাবেন। এক্ষেত্রে আমাকে পাশের সিটে ঝুঁকে পড়ে সামনের রাস্তা দেখতে হতো। অসুবিধা হলেও মানিয়ে নিয়েছিলাম!
রাশিয়া এবং সংলগ্ন রাষ্ট্রগুলোয় সাধারণ মানুষ তো স্থানীয় ভাষা ছাড়া কথাই বলেন না। ভাষার ব্যবধানটা মেটালেন কীভাবে?
কেন গুগ্ল ট্রান্সলেট (হাসি)! এছাড়া বডি ল্যাঙ্গোয়েজ দিয়েও অনেক সময় কমিউনিকেট করেছি।
কোথাও পুলিশের ঝামেলা পোহাতে হয়নি?
অনেকবার হয়েছে। রাশিয়াতে হয়েছে। উজবেকিস্তানেও হয়েছে। রাশিয়াতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছিলাম।
কী রকম?
আমরা তখন মস্কোয় ঢুকছি। রাত হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দেখি আমাদের একটি পুলিশের গাড়ি ফলো করছে। এবং হেড লাইট অন-অফ করে আমাদের থামতে বলছে। গাড়ি থামাতে, ওঁরা বলেন আমি নাকি রাস্তার মিড্ল লাইন ক্রস করেছি। আমি বলি, ‘হতে পারে। কিন্তু আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি।’ ওঁরা আমাকে স্থানীয় থানায় যেতে বলেন। আমি ঠিক কোথায় ভুল করেছি, সেটা জিজ্ঞাসা করতে পুলিশ অফিসার ৫০০ ডলার চেয়ে বসেন। শেষমেশ ২০০ ডলারে রফা হয়। মজার ব্যাপার, টাকাটা নিয়েই সেই অফিসার মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন বুঝতেই পারলাম না!
আপনি তো অটোবান’এও (জার্মানির হাইওয়ে) গাড়ি চালিয়েছেন?
(জোরে হেসে) সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা! অটোবান’এ গাড়ি চালানোটা যে কোনও ড্রাইভারের স্বপ্ন। আমরা ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে অটোবান’এ উঠেছিলাম। মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছি। হঠাৎ এক হাইওয়ে পেট্রলিং কার আমাকে গাড়ি থামাতে বলে। এক দীর্ঘকায় জার্মান পুলিশ অফিসার এসে গাড়ির কাগজ, আমাদের ভিসা এবং পাসপোর্ট দেখতে চান। আমরা সেগুলো ওঁকে দিই। দেখে উনি আমাকে ফেরত দিয়ে দেন। মুচকি হেসে আমাকে গাড়ি থেকে নেমে আসতে বলেন। বুঝতে পারছিলাম না, এখানে আবার কত ইউরো খসতে চলেছে! উনি বলেন, আমাদের সঙ্গে উনি ছবি তুলতে চান। জিজ্ঞাসা করতে বলেন, ‘এটাই অটোবান’এ আমার দেখা প্রথম ভারতীয় গাড়ি! সম্ভবত, এটাই শেষ!’ বুঝুন অবস্থা!
কাজাখস্তান
অটোবান’এ আপনাদের গাড়ির গতি কত ছিল?
মোটামুটি ১৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা।
পুরো সফরকালে কখনও এমন মনে হয়েছে, যে ‘অনেক হল এবার ঘরে ফেরাই ভাল’?
একেবারেই না। পুরো সফরটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। তাই হেরে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। অনেক রকম পরিস্থিতিই এসেছে, কিন্তু সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি।
লন্ডনে তো পৌঁছলেন। গাড়িটা ভারতে ফিরিয়ে আনলেন কীভাবে?
আমরা লন্ডন পৌঁছেছিলাম ২৭ অক্টোবর। গাড়িটা জাহাজে করে ফিরিয়ে এনেছিলাম (হাসি)।
যদিও প্রশ্নটা করা হয়তো উচিত নয়! কিন্তু না জিজ্ঞাসা করে পারছি না। পুরো সফরে আপনাদের খরচ কত হল?
(হেসে) আরে, এটা না বলার কী আছে? (একটু ভেবে) মাথা পিছু ৮-১০ লক্ষ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে!