‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’কেই আপনার সফরের ট্যাগলাইন করার কথা ভাবলেন কেন?
বাইকিংয়ের নেশাটা দীর্ঘদিনের। এর আগে ‘কিপ মাউন্টেন ক্লিন’ ট্যাগলাইন নিয়ে সফর করেছিলাম। কিন্তু এবার কাউকে সঙ্গী হিসেবে পাইনি। তাই সোলো ট্রাভেল। ভেবে দেখলাম, বাইকিংয়ের পাশাপাশি যদি কোনও কিছুর প্রচার করতে পারি তাহলে তো মন্দ হয় না! ভারতের উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছি। সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি। স্থানীয় স্কুলে গিয়েও সেখানকার শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছুটা সময় চেয়ে বাচ্চাদের ক্লাস নিয়েছি। ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’ ক্যাম্পেনের গুরুত্ব কতটা, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। রাজস্থানের গ্রামে গিয়েছি। দেখলাম ইট দিয়ে রাস্তা বাঁধাই করা হচ্ছে। এবং পুরো কাজটাই করছেন মহিলারা। তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তাঁদের ভাবনা-চিন্তাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। আবার জৈসলমেরের কাছে এক গ্রামের মোড়লের সঙ্গে কথা বলে চমকে গিয়েছি!
কেন?
ওখানকার মানুষরা মনে করেন মহিলারা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র। রান্নাঘর সামলানোটা মহিলাদের বাড়তি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ওঁদের বুঝিয়েছি, ছেলেরা যদি সব কাজ করতে পারে, সব রকম স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে, তাহলে মেয়েরাই বা কেন স্বাধীনতা পাবে না! এই প্রচারের মাধ্যমে ওঁদের মানসিকতা কতটা বদলাতে পেরেছি জানি না। কিন্তু সান্ত্বনা একটাই, আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।
ভিনরাজ্যে গিয়ে ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধা হয়নি?
একেবারেই না। বরং ওঁদের কাছ থেকে সহযোগিতাই পেয়েছি। তার কারণও আছে। পরনে বাইকার্স গিয়ার, বাইকে কলকাতার নম্বর প্লেট, হেলমেটে ক্যামেরা লাগানো— সবকিছু দেখে ওঁদের মনে আমার সম্পর্কে কিছুটা হলেও সম্ভ্রম তৈরি হয়েছিল। এমনও হয়েছে, অনেক জায়গায় স্থানীয় মানুষরা নিজে থেকেই এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।
জোধপুরের কাছে এক গ্রামের স্কুলে।
ছত্তিসগঢ়, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে প্রত্যন্ত এলাকায় মহিলাদের অবস্থাটা ঠিক কেমন দেখলেন?
মহিলাদের অবস্থার কথা নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করাটা ঠিক হবে না। মহিলাদের তো বটেই, ওখানে শিশুদের অবস্থাও বেশ খারাপ! রাজস্থানের একটা জায়গায় ছবি তুলব বলে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার পাশে তিনটে বাচ্চা এসে দাঁড়ায়। ব্যাগে দু’টো বিস্কুটের প্যাকেট ছিল। দু’জন বাচ্চাকে প্যাকেটগুলো দিয়ে বলেছিলাম, সকলের মিলে ভাগ করে নিতে। কিন্তু, ওরা কথা শোনেনি। তৃতীয় জনকে না দিয়েই দু’টো বাচ্চা দৌড়ে পালিয়েছিল। আর তৃতীয় বাচ্চাটি ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। দৃশ্যটা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়! বুঝতে পেরেছিলাম, ওদের জীবন কতটা কষ্টের! কোনও রিসোর্সই ওখানে নেই। জৈসলমেরের দিকটায় অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
সরকারের তরফে ভূরি ভূরি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পরেও কিছুই কাজ হয়নি বলছেন?
(একটু ভেবে) বলা মুশকিল। কিন্তু সেভাবে তো কিছু চোখে পড়ল না।
কত বছর ধরে বাইক রাইড করছেন?
২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করি। ওই সময়টায় টুকটাক রাইড করতাম। তারপর একটা বাইকার্স ক্লাবে যোগ দিই। গ্রুপের বাকি সদস্যরা প্রায়ই এদিক-ওদিক রাইডে যেত। ২০১৪ সালে আমি বাইক দুর্ঘটনায় পড়ি। সেই সময় খুব রাফ বাইক চালাতাম। অল্প বয়সের অ্যাড্রিনালিন রাশ আর কী! যাই হোক, দুর্ঘটনার পর থেকে দায়িত্ববান বাইকার হিসেবে রাইড করার
চেষ্টা করি।
রাজস্থানের একটি গ্রামের লোকেদের সঙ্গে।
আপনার ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’ সফরটা কেউ স্পনসর করেছিলেন?
স্পনসরশিপের জন্য অনেকের কাছেই গিয়েছিলাম। লাভ হয়নি। তাই নিজের জমানো টাকা দিয়েই ট্যুরটা করেছিলাম।
খরচ কত পড়ল?
৩০ হাজার টাকার কাছাকাছি।
এর আগে কোথায় কোথায় গিয়েছেন?
সিকিম, ভুটান, অরুণাচলপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, গুজরাত। এই তো দিন তিনেক আগেই সিকিম থেকে ঘুরে এলাম।
একক সফরের রুটম্যাপ তৈরি করেছিলেন কীভাবে?
ছোটবেলা থেকেই মানচিত্র ব্যাপারটা আমাকে খুব টানে। তা সে গুগ্ল ম্যাপ হোক বা মানচিত্রের কোনও বই। সময় পেলেই এইসব নিয়ে বসে পড়ি। নতুন রাস্তা চেনার চেষ্টা করি। যাই হোক, এগুলো করে করে এখন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। দেশের বা রাজ্যের কোথাও যেতে হলে কোন রাস্তা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে, সেটা বলে দিতে পারি। আর যে রাস্তাগুলো চিনি না, তার জন্য জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলাম। যেমন দিল্লি যাওয়ার সময় কোনও অসুবিধাই হয়নি। ডানকুনি থেকে এনএইচ-টু ধরে সোজা দিল্লি পৌঁছই। কিন্তু দিল্লির মধ্যে কোনও জায়গায় যাওয়ার সময় জিপিএস প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে।
রাইডের সময় বাইকার্স গিয়ার পরে নেন নিশ্চয়ই?
একদম। জুতো তো থাকেই। নি এবং এলবো গার্ড থাকে। আমেরিকান সেফ্টি স্ট্যান্ডার্ডের একটা ভাল হেলমেট ব্যবহার করি। আর সফর শুরুর আগে বাইকটাকে ভালভাবে চেক করে নিই। আসলে কেউ যদি সারা বছর বাইককে যত্নে রাখেন, তাহলে আলাদাভাবে কোনও কিছু করার দরকার পড়ে না। আর হ্যাঁ, এই ধরনের সফরের সময় ইঞ্জিন অয়েল সঙ্গে রাখি।
দূরপাল্লার সফরের ক্ষেত্রে বাইকারদের প্রথম পছন্দ তো রয়্যাল এনফিল্ড। সেক্ষেত্রে আপনি পালসার ২২০’কেই বেছে নিলেন কেন?
রয়্যাল এনফিল্ড একটা পারসেপশন। অনেকে বুলেটকে কিং অফ রোড মনে করেন। কিন্তু মাঝরাস্তায় চাকা পাংচার হয়ে গেলে, বুলেট ঠেলতে জীবন বেরিয়ে যাবে। পাহাড়ি রাস্তায় বুলেটের সত্যিই বিকল্প নেই! বাইকটা ভাল। কিন্তু বুলেট যখন বিগড়ে যাবে, তখন আপনি বড় রকমের সমস্যায় পড়বেন। অন্য বাইক যদি মাইলেজ
বেশি দেয়, বা দ্রুতগামী হয়— তাহলে কেন সেই বাইক ব্যবহার করব না?
বাইকপ্রেমীদের কোনও মেসেজ দিতে চান?
(একটু ভেবে) সকলকে সতর্ক হতে হবে। একটু সাবধানে রাইড করলেই দেখবেন, অনেক বড় বিপদ থেকে অনায়াসে রক্ষা পেয়ে যাবেন।
(ছবি: সুনীতের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে)