নস্ট্যালজিয়া বাঙালির শিরায় শিরায়। কিন্তু পুরনো-তে আটকে থাকলে দেশের বাকি শহরের সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবে কলকাতা? এই প্রশ্ন নতুন প্রজন্মের বড় অংশের। তাই কলকাতাও সাবেকি থেকে ক্রমশ কর্পোরেট হওয়ার দিকে ঝুঁকছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, রসগোল্লা, রাজনীতি— এসব থেকে বেরিয়ে আজ কলকাতাতে শপিং মল, পাব সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু তা বলে কি পুরোনো কলকাতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়? উত্তর ও মধ্য কলকাতার ভাঙাচোরা বাড়ির দেওয়াল চুঁয়ে জলের দাগ, পুরোনো দেওয়াল জুড়ে ছেঁড়াফাটা রাজনৈতিক পোস্টার, এই সবের সঙ্গে রুফটপ পাব, বিদেশি ব্র্যান্ডে ভরা শপিং মল কিন্তু দিব্যি সহাবস্থানে।
হলুদ ট্যাক্সির বদলে ওলা-উবের বা ওয়াচেল মোল্লা বা কমলালয় স্টোর থেকে সিসি ১ বা সিসি ২— এই বদলগুলোর সঙ্গে বদলেছে ‘সিটি অফ জয়’-এ আনন্দ মুহরতগুলোও। কিন্তু কলকাতা থেকে ইতিহাস বাদ দেওয়া আর মানবদেহ থেকে হৃৎপিণ্ড বাদ দেওয়া প্রায় সমান। বাঙালি আজ যতই ‘উন্নয়ন’-এর কথা মাথায় রেখে, ঘরের ছেলেমেয়েদের বেঙ্গালুরু-পুণে পাঠাক, কলকাতার হেরিটেজ অনস্বীকার্য। ‘কিন্তু হেরিটেজ ধুয়ে কি আর কেরিয়ার গড়া যায়’— এই প্রশ্নের ঠুলি চোখে বেঁধে বাঙালি আজ বড়ই আত্মকেন্দ্রিক।
অন্যান্য শহরের কাছে শুধুই মানুষের রোজকার চাকরি জীবন, বা উইকেন্ডে পাবে গিয়ে আনন্দটাই পরিচিত। এই সব শহরের সবাই যেন ‘হ্যাপি গো লাকি’। এখানেই কলকাতা ব্যতিক্রমী। কলকাতা যেমন দুর্গাপুজো বা বড়দিনের আগের আনন্দর সঙ্গে পরিচিত। তেমনই বাঙালির ডিপ্রেশন, পুরনো স্মৃতি ঘিরে মনের মধ্যে জমে থাকা মেঘ— সবটারই সাক্ষী থাকতে জানে কলকাতা। তাই বাঙালির কমফর্ট জোন হিসেবে কলকাতাই সর্বাগ্রে।
কিন্তু কলকাতার এই হেরিটেজ কতদিন বেঁচে থাকবে? নাকি উন্নয়নের চাপে মুখ ঢাকবে শহরের হেরিট্যেজ বিল্ডিং ও মেস বাড়ি। কলকতায় বহু মেস বাড়ি রয়েছে, যেগুলিতে আজও বাস করে বহু অজানা গল্প। সেই অজানা গল্পকে বাঁচাতে এবং সবার কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিল ‘হেরিটেজ ওয়াক ক্যালকাটা’। পুরনো কলকাতার ইতিহাস নিয়ে ‘হেরিটেজ ওয়াক ক্যালকাটা’ তৈরি করে ফেলেছে একটি ওয়েব সিরিজ। তার পাইলট এপিসোডটি রিলিজ করল ২৪ নভেম্বর। ‘হেরিটেজ ওয়াক ক্যালকাটা’-এই ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে ওয়েব সিরিজটি। পরিচালক জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার তথাগত নিয়োগীই এই অসামান্য উদ্যোগ নিয়েছেন। ওয়েব সিরিজটির অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর সৌমিত দেব। জয়দীপ ও সৌমিত মিলেই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। ব্যাগ কাঁধে করে শহরের বিভিন্ন রাস্তা থেকে গল্প সংগ্রহ করে তা পৌঁছে দিয়েছেন উপস্থাপিকা অঙ্কিতা রায়।
‘অপরাজিত’(১৯৫৬), ‘সাড়ে চুয়াত্তর’(১৯৫৩)-সহ বহু পুরনো বাংলা ছবিতে রয়েছে মেসবাড়ির উল্লেখ। শুধু পর্দায় নয়, কলকাতার বহু ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে মেসবাড়ি থেকেই। বাস্তবেও তেমনই এক সময়ে ২৭ নম্বর কানাই ধর লেনের মেসবাড়ি থেকেই ছাপা হতো অনুশীলন সমিতির মুখপত্র। ব্রিটিশ পুলিশ প্রায়ই হানা দিত সেই মেসে। পাইলট এপিসোডেই দেখা যাবে শিব্রাম চক্রবর্তীর মুক্তারাম বাবু স্ট্রিচের সেই বিখ্যাত মেসবাড়ি। ওইরকম অন্ধকার গুমটি মতো ঘর থেকে যে ওই মাপের রসবোধ বেরিয়ে আসতে পারে, আজকের আত্মকেন্দ্রিক বাঙলি হয়তো ভাবতেই পারবেন না। মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট-এর এই মেস বাড়িতে আজও লোকের বসবাস আছে। রয়েছে মেস-এর দেওয়ালে শিব্রাম চক্রবর্তীর হাতের লেখাও।
কলকাতার আরও একটি বিখ্যাত বোর্ডিং হাউস ‘প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস’-এর উল্লেখ রয়েছে এই এপিসোডে। এখানে কলেজ জীবনে থাকতেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানেই থেকেছেন জীবনানন্দ দাশও। তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে আসতেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তও।
শুধু সত্যিকারের চরিত্র নয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের অমর সৃষ্টি ঘনাদাও থাকতেন বনমালী সরকার স্ট্রিটের মেস-এ। তাঁকেও কি দেখা যাবে পরের কোনও এপিসোডে? কাহিনি থেকে বাস্তব যে খুব বেশি দূরে নয়, তা কলকাতার যে কোনও মেস বাড়িতে পা রাখলেই বোঝা যায়।