হৃৎপিণ্ডের জোর আছে? নইলে ঝুঁকি নেবেন না। কেননা, যে বিষয় নিয়ে এই প্রতিবেদন, তা নিঃসন্দেহে দুর্বলচিত্তের চোখে সইবে না। তাই আগেভাগে বুঝে নিন। অতঃপর সিদ্ধান্ত।
২১৪ ফিট উঁচু মিনারে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছেন এক তরুণ। কোনও কিছুর সাহায্য তো নেই-ই, উল্টে কোমরে, পিঠে রয়েছে কাপড়ের গাঁটরি। পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে এমন দৃশ্য দেখা যায় রোজ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— বারো মাস। প্রতিদিন মন্দিরের পতাকা পাল্টানো হয়। আর এভাবেই একজন কোনও সাহায্য ছাড়া মন্দির বেয়ে উঠে পড়েন একেবারে টঙে। এই প্রথা চলে আসছে গত ৮০০ বছর ধরে। হলফ করে বলা যায়, পৃথিবীর যে কোনও সার্কাসকে টেক্কা দেবে এই পতাকা পরিবর্তনের পর্ব।
সন্ধে নামলেই শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। জগন্নাথ মন্দির চত্বরে ছোটখাটো বহু মন্দির থেকে যখন গুনগুন করে মন্ত্রপাঠের সুর ভেসে আসছে, তখনই একটি মন্দিরের চাতালে কোমরে রং-বেরঙের কাপড় জড়াচ্ছেন বছর কুড়ি-বাইশের যুবা। প্যাঁচের পর প্যাঁচে জড়িয়ে গেল কোমর, পিঠ। ঘাড় বেয়ে আড়াআড়ি নেমে এল যে বিশাল কাপড়টি, সেটিই মূল পতাকা। টাঙানো হবে জগন্নাথ মন্দিরের একেবারে উপরে লাগানো চক্রের (নীল চক্র) সঙ্গে লাগানো দণ্ডে। অষ্টধাতুর তৈরি নীলচক্রের গায়ে যে পতাকাটি এ ভাবে রোজ টাঙানো হয়, তার নাম ‘পতিতপাবন’।
এ তো গেল শুষ্ক তথ্য। যে ঘটনা চোখের সামনে রোজ ঘটছে, তা ক্যামেরায় ধরার অনুমতি নেই। ফলে, চাক্ষুষ করতে গেলে জগন্নাথ মন্দিরের চাতালে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। যাঁরা এ কাজ করছেন, তাঁদের ছবিও তোলা বারণ। কথাবার্তা বলে জানা গেল, জগন্নাথের সেবায় এঁরা প্রাণের ঝুঁকি নেন। এবং এটা তাঁদের কাছে একেবারেই স্বাভাবিক বিষয়।
জোরালো হাওয়া বইতে শুরু করেছে তখন। পড়ন্ত বিকেলের আকাশে মেঘের আনাগোনা। যদি বৃষ্টি হয়? প্রশ্ন শুনে মন্দিরের কাজে নিযুক্ত এক যুবকের চোখে ঝিলিক খেলে গেল যেন— ‘‘তা হলে আরও ভাল লাগবে পতাকা টাঙানো দেখতে।’’
এর পর কথায় কথায় অনেক কিছুই জানালেন তিনি। যাঁরা মন্দিরের উপরে এভাবে পতাকা টাঙাচ্ছেন, তাঁরা চোল বংশের একটি বিশেষ শাখার সদস্য। এঁদেরই পূর্বসূরি প্রথমবারের জন্য জগন্নাথ মন্দিরের দেওয়াল বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে পতাকা টাঙিয়েছিলেন। তার পর থেকে শুধুমাত্র এই পরিবারেরই অধিকার রয়েছে পতাকা টাঙানোর। একেবারে ছেলেবেলা থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধাপ রয়েছে প্রশিক্ষণের। সে সব পেরিয়ে তবেই মেলে মন্দিরে চড়ার অনুমতি।
দেওয়াল বেয়ে ওঠা বলতেই ‘স্পাইডারম্যান’-মার্কা যে চেহারা ভেসে ওঠে, পুরীর ব্যাপারটা তার চেয়েও মারাত্মক। কেননা, দেওয়াল বেয়ে ওঠার সময়ে মন্দিরের দিকে তাকানো নিষেধ! অর্থাৎ, স্পাইডারম্যানকে যেভাবে দেওয়ালে হামাগুড়ি দিতে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। মন্দিরের দেওয়ালের দিকে পিঠ করে হাত দুটো দিয়ে ঠেলে ঠেলে দেওয়াল বেয়ে মন্দিরে ওঠা। চোখ থাকবে সামনের দিকে।
মাধ্যাকর্ষণের সূত্র সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা রয়েছে, তাঁরাও বুঝতে পারবেন এ কাজ কতটা কঠিন। তার উপর কোমরে-পিঠে পতাকার বিশাল বোঝা। কিন্তু বুকে কাঁপুনি ধরার তখনও যে বাকি ছিল, বোঝা গেল মিনিট ১৫-২০ পর। পতাকা টাঙিয়ে তুমুল হাততালির মধ্যে তরুণ নামতে শুরু করলেন দেওয়াল বেয়ে। এবং সেটিও ঠিক একই কায়দায়। কথাবার্তায় আগে জেনেছিলাম, নিয়ম একটাই। ওঠা বা নামার সময়ে মন্দিরের দিকে তাকানো চলবে না। তাকাতে হবে সামনের দিকে। মাধ্যাকর্ষণের টানে প্রায় খাড়া দেওয়াল বেয়ে নেমে আসার ঝুঁকি নেওয়ার এই পালা চলছে গত আট শতক ধরে।
প্রতি একাদশীতে নীলচক্রের সামনে একটি প্রদীপও জ্বালিয়ে আসতে হয়। এই পর্যায়ের ফিটনেস ধরে রাখতে কী করেন এঁরা? জানা গেল, নানা কসরত তো আছেই। সঙ্গে খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও চলতে হয় নিয়ম মেনে।
ততক্ষণে পতাকার টুকরো কাপড় কেনার ভিড় জমে গিয়েছে চারপাশে। সকলের হাতে উঁচিয়ে একশো টাকার নোট। কেউ কেউ আবার যিনি পতাকা টাঙিয়েছেন, তাঁকে প্রণামই করে ফেলছেন। ওঠার আগে এবং নেমে এসে একটি নির্দিষ্ট থামে প্রণাম করেন পতাকা টাঙিয়েরা। সেই থামের সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু জগন্নাথ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে এক যুবক। ধীরে ধীরে সন্ধে গিয়ে রাত আসছে।
মন্দির চত্বরে তখনও বেশ ভিড়। চেনা যুবক এসে বললেন, ‘‘মহাপ্রসাদ খাবেন?’’ ‘‘হ্যাঁ’’ বলতেই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। নজর গেল নীলচক্রের দিকে। ফ্লুরোসেন্ট কমলা আর সাদা পতাকার বদলে হলুদের উপর লাল স্বস্তিকা আঁকা পতাকা উড়ছে। শুনতে অবাক লাগলেও, জগন্নাথের পতাকা সবসময়ে হাওয়ার বিপরীত দিকে ওড়ে। কীভাবে, সে সব ব্যাখ্যায় মন টানছিল না। মস্তিষ্কজুড়ে শুধু এক তরুণের দাপট। তরতরিয়ে ২১৪ ফিট উঠে, পতাকা টাঙিয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে নেমে আসার মোট সময় মেরেকেট মিনিট কুড়ি-পঁচিশ। এ-ও কি সম্ভব!
বিস্ময়ের ঘোর কাটল ডাকে— ‘‘দাদা। মহাপ্রসাদ।’’ শালপাতায় ছোট, গোলগোল মালপোয়া হাতে দাঁড়িয়ে এক তরুণ। দর্শনার্থীর চোখে অপার বিস্ময়ে যেন বেশ মজা পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘‘অবাক হবেন না দাদা। শ্রীজগন্নাথের মন্দিরে সবই যে অন্যরকম।’’
ব্যাখ্যা? এটাই সম্ভবত সেরা।
আরও পড়ুন
পুরী গিয়ে যে ১০টি কাজ ভুলেও করবেন না