কামরান আলি ও তাঁর সাইকেল-সফরের
আরও ছবি দেখতে CLICK করুন
কলকাতায় তখন রাত সাড়ে ১০টা। নির্ধারিত সময়ে তাঁকে ফোন করা হলে দশ মিনিট সময় চেয়ে নিলেন তিনি। অপেক্ষার পর আবার ফোন করে জানা গেল, রাস্তার ধারে সুবিধেমতো জায়গায় সাইকেল থামানোর জন্যই সময় চেয়েছিলেন কামরান। বলিভিয়ায় ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে ১২টার কাছাকাছি। সাংবাদিককে কামরানের প্রশ্ন, ‘‘হিন্দি বলতে পারেন?’’ ইতিবাচক উত্তর পেয়ে হিন্দিতেই শুরু হল কথাবার্তা। মাঝেমধ্যে ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ। তার মধ্যেই চলল সাক্ষাৎকারপর্ব।
সাইকেলে চড়ে প্রায় ৩০টা দেশ ঘুরেছেন আপনি। বিশ্বভ্রমণের জন্য সাইকেলই বাছলেন কেন?
(হেসে) সাইকেলের প্রতি আমার দুর্বলতা ছোটবেলা থেকেই। আর সাইকেলে চড়ে কোথাও গেলে অনেক বেশি সময় পাওয়া যায়। যেটা গাড়িতে বা বাইকে গেলে মেলে না। সাইকেলের গতি কম। তাই চারপাশ দেখতে দেখতে নিজের মতো চলা যায়। একেকটা দেশ বা জায়গা পার হওয়ার পর আশপাশের ল্যান্ডস্কেপ কীভাবে বদলে যায়, সেটা একমাত্র সাইকেলেই চাক্ষুষ করতে পারবেন। এমনকী, পথের চড়াই-উতরাইও অনুভব করতে পারবেন! এগুলো গাড়িতে গেলে বুঝতে পারবেন না। তাছাড়াও সাইকেলে চেপে কোথাও গেলে সেখানকার স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগটাও বেশি পাওয়া যায়। সাইকেল-আরোহী বলে তারাও আপনাকে অন্য নজরে দেখেন। আর খরচ কমের ব্যাপারটা তো রয়েছেই! প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল।
বেড়ানোর নেশাটা কি ছোট থেকেই?
দেখুন, বেড়াতে সকলেই ভালবাসে! যখন পাকিস্তান থেকে জার্মানিতে পড়তে যাচ্ছিলাম, ফ্লাইটের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এটাই আমার প্রথম পাকিস্তানের বাইরে যাওয়া! মনে হয়েছিল, যে পাহাড়-নদী-জলাশয়ের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি, দেশে ফেরার সময় ওই জায়গাগুলো সাইকেলে চড়ে পার হলে কেমন হয়? সেই শুরু।
আপনি কি একাই সফর করেন?
শুরুটা একাই করি। তবে অনেক সময় পথে অন্য সাইক্লিস্টদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আর্জেন্তিনা যাওয়ার সময় রাস্তায় দু’জন ফরাসি সাইকেল-আরোহীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমরা প্রায় তিন মাস একসঙ্গে সফর করেছি। তারপর আমাদের রুট আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা ওঁদের পথে গিয়েছিলেন, আমি আমার। তবে আমার মতে, একা বেড়ানোই ভাল! এতে যেমন খুশি চলা যায়। কোনও জায়গা পছন্দ হলে, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেও তাড়া দেওয়ার কেউ নেই।
অচেনা-অজানা দেশে একা ট্যুর করেন। নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন না?
(একটু ভেবে) অনেক সময় করি! এমনও হয়েছে, টানা দু’সপ্তাহ এমন জায়গা দিয়ে গিয়েছি, যেখানে জনমানব নেই। সেই সময় একটু চিন্তা হতো বইকী! যত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন, তত মানুষ হিসেবে পরিণত হয়ে উঠবেন— এই কথাটা আমি খুব বিশ্বাস করি। মাসের পর মাস নিজের সঙ্গে সময় কাটালে নানা চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। যেগুলো মানুষ হিসেবে আমাকে সমৃদ্ধ করে। জীবন সম্পর্কে আমার মনে যে প্রশ্নগুলো রয়েছে, ভ্রমণের সময় নিজেকে সেই প্রশ্নগুলোই করি। মজার ব্যাপার, সাধারণভাবে না পেলেও এই সময় আমি উত্তরগুলো পেয়ে যাই।
সফর পরিকল্পনা করেন কীভাবে?
প্রথমেই যেটা দেখি সেটা হল, যে সব জায়গায় যেতে চাই সেখানকার রাস্তার কেমন অবস্থা। তারপর সেই জায়গাটার এলিভেশন প্রোফাইল দেখি। যারা সাইকেলে ট্র্যাভেল করেন, তাঁদের কাছে এলিভেশন প্রোফাইলটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিনে আমি মোটামুটিভাবে ৬০-৭০ কিলোমিটার সাইকেল চালাই। তাই দিন শুরু করার আগে দেখে নিই আগামী ৬০-৭০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও শহর রয়েছে কিনা। শহর থাকলে ভাল। যদি না থাকে, তাহলে পরের শহর কত দূরে সেটা দেখে নিই। সেইমতো খাবার, পানীয় জল সঙ্গে নিয়ে নিই। যখন চিলে থেকে সফর শুরু করেছিলাম, ১০ দিনের সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়েছিলাম। আবার যাত্রাপথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে এমন জায়গা পড়লে বাড়তি সময় বরাদ্দ করে রাখি। যাতে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি।
পথ চিনতে কি জিপিএস’এর সাহায্য নেন?
আমার কাছে সব সময় জিপিএস মেশিন থাকে। যে পথে যাব, সেটা আগে থেকেই জিপিএস মেশিনে সেট করে দিই। যে পথে যাচ্ছি, সেই পথে আগে কেউ গিয়ে থাকলে, সেই রুটম্যাপও ডাউনলোড করে নিই অনেক সময়। এছাড়াও আমি যেখানে রয়েছি সেখানকার অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা দেখার যন্ত্রও থাকে আমার কাছে।
আপনি তো এখন বলিভিয়ায় রয়েছেন। অচেনা দেশে গিয়ে ভাষাগত সমস্যাটা সামলাচ্ছেন কীভাবে?
এসব ক্ষেত্রে বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বড় ভূমিকা নেয়। হাবেভাবে অনেক কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায়। এছাড়াও আমার ফোনে ডিকশনারি এবং অফলাইন গুগ্ল ট্রান্সলেটর রয়েছে। সেগুলো ব্যবহার করি। আর কোনও দেশে দীর্ঘদিন থাকলে, সেখানকার স্থানীয় ভাষাও একটু একটু শিখে নেওয়া যায়। ভাষাগত সমস্যা নিয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছিল গত বছর। জার্মানি থেকে পাকিস্তান যাওয়ার সময়। প্রতিটা দেশ এত দ্রুত পেরিয়ে গিয়েছিল যে, ভাষা শেখার সময়টাই পাইনি। তাই কোনও দেশে পা দিয়েই আমি একটা বেসিক ডিকশনারি কিনে নিতাম।
আপনি তো মুলতান থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন...?
আমার বাবার টায়ারের ব্যবসা ছিল। মুলতান থেকেই কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশন করি। তারপর মাস্টার্স পাশ করে শিক্ষকতার কাজ নিই। কিন্তু একটা সময়ের পর একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিল। তাই চাকরি ছেড়ে দিই। কিছুদিন পর ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে শুরু করি। শেষমেশ জার্মানিতে আবার কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে মাস্টার্স করি। তারপর রকস্টক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পিএইচডি। জার্মানিতেই কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কিছুদিন চাকরি করি। তারপর সেই চাকরিও ছেড়ে দিই। জীবনে আমি অনেকবার চাকরি ছেড়েছি (হাসি)।
জার্মানি থেকে পাকিস্তান— সফরটা তো আপনার মায়ের উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন...।
হ্যাঁ। সফর শুরুর সময়ই প্ল্যান করেছিলাম, পাকিস্তান পৌঁছে প্রথমেই মায়ের সঙ্গে দেখা করব। তুরস্ক পার হওয়ার সময় মায়ের হার্ট অ্যাটাকের খবর আসে। আমি তুরস্কে যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে সিভাস শহরে পৌঁছতে দু’দিন লেগেছিল। তারপর বাসে ইস্তানবুল যাই। সেখান থেকে পাকিস্তানের ফ্লাইট ধরি। যখন বাড়ি পৌঁছই, মা তখন হাসপাতালে। কিছুদিন পর মা মারা যান। মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে, বেশ কয়েক বছর পাকিস্তানেই ছিলাম। তারপর জার্মানি ফিরি। তারপর আবার তুরস্ক থেকে সাইকেলে পাকিস্তানের উদ্দেশে সফর শুরু করি। পাকিস্তান পৌঁছে মায়ের সমাধিস্থানে গিয়েছিলাম। খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম ওই সময়টায়। প্রায় আট বছর পর আমি সফরটা শেষ করতে পেরেছি।
শোনা যায়, কাজাখস্তানে এক মহিলা আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন?
(জোরে হেসে) দিস ইজ দ্য মোস্ট পপুলার স্টোরি অন মি অন ফেসবুক। ঘটনাটা কাজাখস্তানের পামির হাইওয়ে ধরে যাওয়ার সময় হয়েছিল। ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে একটা পরিবারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ওঁরা আমাকে চা-খাবার দেন। ওঁদের পরিবারে একজন অবিবাহিত মেয়ে ছিল। হঠাৎ সেই পরিবারের বয়স্করা আমাকে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে বলেন। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, সে এমন কাউকে বিয়ে করতে চায়, যে দিনে নিয়ম করে পাঁচবার নমাজ পড়ে। আমি যে তা করি না, সে কথা ওকে জানাই। এটা শুনে মেয়েটি সরাসরি জানিয়ে দেয় যে, ও আমাকে বিয়ে করবে না (হাসি)! আমাকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। পরে জেনেছি, এটাই কাজাখস্তানের রীতি। বাড়িতে অবিবাহিত মেয়ে থাকলে, ওরা এভাবেই প্রস্তাব দেয়।
সাইকেল নিয়ে প্রায় সারা বিশ্ব ঘুরেছেন। কখনও ভারতে আসার ইচ্ছে হয়নি?
আরে, আমার তো খুব ইচ্ছে ভারতে যাওয়ার! গত বছর যখন পাকিস্তানে গিয়েছিলাম, ভারতের ভিসার জন্য আবেদনও করেছিলাম। জন্মসূত্রে আমি পাকিস্তানি। কিন্তু আমার পাসপোর্ট জার্মানির। সমস্যাটা হয়েছিল সেখানেই। অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, আমার পক্ষে ভারতের ইন্ডিভিজুয়াল ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া সম্ভব নয়। আমি ভারতে কাউকে চিনিও না। তাই একটা সময়ের পর হাল ছেড়ে দিই। ভারতের প্রতি আমার দুর্বলতার একটা কারণও রয়েছে। আমার পূর্বপুরুষেরা আগে সুক্রিতে থাকতেন।
জব্বলপুরের সুক্রির কথা বলছেন?
(হেসে) সেটা ঠিক বলতে পারব না! ইচ্ছে ছিল ভিসা পেলে সুক্রি থেকে পাকিস্তান অবধি সাইক্লিং করার। কিন্তু ভারতীয় ভিসা আধিকারিকদের সন্তুষ্ট করতে পারলাম কই! ভারতে যাব বলে আগ্রাতে একটা হোটেলও বুক করে ফেলেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না!
আপনি কি বিবাহিত?
নাহ্।
বিশ্বভ্রমণ করবেন বলেই কি বিয়ে করার কথা ভাবেননি?
এই প্রশ্নের কী উত্তর দিই বলুন তো! (একটু ভেবে) জোড়ি তো আসমানো মে বনতে হ্যায় (হাসি)। আপনাদের সোনু নিগমের একটা গান রয়েছে না, ‘চুড়িয়া বনতি হ্যায় দুকানো মে, জোড়িয়া উপর আসমানো মে’! আমার ক্ষেত্রেও তাই। উপরওয়ালা আমার জন্য কাউকে বানাননি হয়তো! জোক্স অ্যাপার্ট, বিয়েটা আর করা হয়ে উঠল না!
আপনি তো বলিউডের ফ্যান দেখছি?
আমি তো বড়ই হয়েছি বলিউডের গান শুনে, সিনেমা দেখে। এস পি বালাসুব্রহ্মণ্যম, সোনু নিগম এবং উদিত নারায়ণ হলেন আমার পছন্দের গায়ক। আগে দেখতাম, কিন্তু বলিউডের ছবি এখন খুব একটা দেখা হয় না। আমার আর্ট ফিল্ম বেশি পছন্দের। আর এখন বলিউড মানেই তো মসালা ছবি! তাছাড়া ইদানীং সময়ও মেলে না খুব একটা।
আপনার দেখা শেষ বলিউড ছবি কী?
(একটু ভেবে) ‘পিকে’। সলমন খানের ছবিও খুব ভাল লাগে। আমি ওঁর ফ্যান! গুলজারের শায়েরিও খুব ভাল লাগে।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে চাপানউতোর চলছে, একজন পাকিস্তানি হিসেবে কি আপনি সেটা সমর্থন করেন?
ইউ ক্যান নট চেঞ্জ ইওর নেবার! প্রতিবেশীকে নিয়েই চলতে হবে। এখন জার্মানিতে বসে যখন ভারত-পাকিস্তানের তিক্ততার খবর পাই, খুব কষ্ট হয়। দু’টো দেশের মধ্যে সংস্কৃতি, ভাষা, মানসিকতার পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা দু’টো দেশকেই মেনে নিতে হবে। কারণ, কোনও অপশন নেই। আমি বহু দেশ ঘুরেছি। দেখেছি যে দু’টো দেশ এককালে যুদ্ধ করত, এখন তারা শান্তিতে সহাবস্থান করছে। প্রতিরক্ষা খাতে ভারত এবং পাকিস্তান যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে সেটা যদি সাধারণ মানুষের কাজে লাগানো যেত, দেশে সম্ভবত দারিদ্র্যই থাকত না। দেখুন, দু’টো দেশকেই উদারমনা হতে হবে। মাইন্ড ইজ লাইক আ প্যারাশ্যুট। ইট ওনলি ওয়ার্কস হোয়েন ইট’স ওপেন! ভারত এবং পাকিস্তানের তিক্ত অতীত থাকতেই পারে। কিন্তু সেই অতীত নিয়ে ক্রমাগত চর্চা চালিয়ে ভবিষ্যৎকেও তিক্ত বানানোর কোনও অর্থ হয় না। দু’টো দেশের মধ্যে যতটা পার্থক্য রয়েছে, তার চেয়ে সাদৃশ্যের সংখ্যাই বেশি। অতীতকে ভুলে ভারত এবং পাকিস্তান যদি বন্ধু হতে পারে, তাহলে আখেরে দু’দেশেরই মঙ্গল।
ছবি: কামরানের ফেসবুক পেজ @KamranOnBike থেকে।