পুজোর ইতিহাস: এ বছর জোড়াসাঁকো দাঁ বাড়ির পুজোর ১৭৬তম বর্ষ। ১৮৪০ সালে এই পুজো প্রচলন করেন শিবকৃষ্ণ দাঁ। দাঁ পরিবারের আদি বসতি ছিল বর্ধমানের সাতগাছিয়ায়। তার পর কলকাতায় জোড়াসাঁকো এলাকায় বাড়ি তৈরি করে চলে আসেন গোকুলচন্দ্র দাঁ। গোকুলচন্দ্রের পুত্র শিবকৃষ্ণ ছিলেন সেই সময়কার নামজাদা ব্যবসায়ী। গন্ধক আর খণ্ডমাল, অর্থাৎ লোহা, কাঠকয়লার ব্যবসায় সুনাম ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন শিবকৃষ্ণ। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনিই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। যা এখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে।
শিবকৃষ্ণের আমলে দাঁ বাড়ির পুজোর সঙ্গে রেষারেষি ছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুজোর। সেই সময়ে দাঁ বাড়ি থেকে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা নিয়ে বেরিয়ে চিৎপুরের দিকে যেতে হলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ ছিল না। তাতে এই রেষারেষি আরও ইন্ধন পেত। দাঁ বাড়ির প্রতিমা খ্যাত ছিল সাগরপার থেকে আনা সোনার গয়নার জন্য। বিসর্জনের সময়ে সেই গয়না স্বভাবতই খুলে নেওয়া হত প্রতিমার গা থেকে। কিন্তু একবার প্রিন্স দ্বারকানাথ শিবকৃষ্ণকে টেক্কা দেওয়ার জন্য নিজের বাড়ির প্রতিমা একেবারে সোনার গয়না সমেতই গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। শিবকৃষ্ণের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ প্রিয়ব্রত দাঁ এই প্রসঙ্গে বললেন, ‘এই কাণ্ড ঘটিয়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ সেই সময়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন কলকাতায়। সাধারণ মানুষের সম্ভ্রম বেড়ে গিয়েছিল তাঁর প্রতি। কিন্তু সাধারণ মানুষ যেটা জানেনি সেটা এই যে, দ্বারকানাথের প্রতিমায় খাঁটি সোনার গয়না ছিল না।’ অবশ্য এরকম ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল, নাকি পুরোটাই নিছক গল্পকথা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে জানান প্রিয়ব্রতবাবু।
পুজোর বিশেষত্ব: একসময়ে কলকাতায় এমন কথা প্রচলিত ছিল যে, জোড়াসাঁকো দাঁ বাড়িতে মা আসেন গয়না পরতে। ইউরোপ থেকে আসা গয়নায় সেজে উঠত দাঁ বাড়ির প্রতিমা। প্রতিমার ডাকের সাজ প্যারিস আর জার্মানি থেকে বানিয়ে আনতেন শিবকৃষ্ণ। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে ডাকের সাজ আনার এই রীতি প্রচলিত ছিল। সেই ডাকের সাজের কিছুটা এখনও চালচিত্রের তবক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তামা আর পিতলের সংমিশ্রণে তৈরি এই তবক এখনও সাদা জলে সামান্য ধুয়ে নিলেই একেবারে নতুন ধাতুর মতোই চকচক করে।
দাঁ বাড়িতে পুজো হয় বৈষ্ণব রীতি মেনে। যদিও দুর্গার বাহন সিংহের মুখ ঘোড়ার আদলে নয়। বৈষ্ণবীয় রীতি অনুসরণের কারণেই পশুবলি বা প্রতীকী বলির প্রচলন এখানে নেই। পুজোতে অন্নভোগ হয় না। লুচি গজা খাজা ইত্যাদি দিয়ে ভোগ প্রস্তুত করা হয়। এখনও পুজোতে দাঁ বাড়ির সকলে একত্র হন। নিষ্ঠাভরে সারা হয় পুজো।
কীভাবে যাবেন: গিরীশ পার্ক থেকে বিবেকানন্দ রোড ধরে চিৎপুরের দিকে কিছুটা এগোলে ভাঙা উড়ালপুলের নীচে ডানহাতে পড়বে আইসিআইসিআই ব্যাংকের একটি শাখা। তার বিপরীতে রয়েছে শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বাঁ হাতে ১২ নম্বর বাড়িটিই হল জোড়াসাঁকো দাঁ বাড়ি।