ওড়িশার সংস্কৃতি অনেক প্রাচীন। আর সেই প্রাচীন সংস্কৃতিরই অন্যতম অঙ্গ রথযাত্রা। তবে শুধু রথযাত্রাই নয়, প্রভু জগন্নাথের গুণ্ডিচা বাড়িতি দিন যাপন থেকে জগন্নাথ-পত্মী লক্ষ্মীকে নিয়ে অনেক কাহিনি রয়েছে।
জগন্নাথ বৈষ্ণবদের কাছে স্বয়ং বিষ্ণু। আবার শাক্ত ও শৈব্যরা মনে করেন তিনি ভৈরব শিব। শ্রীক্ষেত্রের এই হরি-হর অভেদ তত্ত্ব ওড়িশা সংস্কৃতির আর এক পরিচয়।
এটা সকলেরই জানা যে, জগন্নাথদেবের মন্দিরের সামনে 'বড়দাণ্ড' নামক প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে রথ টেনে নিয়ে যাওয়া হয় উত্তর দিকে গুণ্ডিচা বাড়ি পর্যন্ত।
প্রাচীন রীতি অনুসারে বিগ্রহ রথে তোলার পরে ওড়িশার গজপতি রাজবংশের প্রতিনিধি পথ পরিষ্কার করেন সোনার ঝাঁটা দিয়ে। প্রভু জগন্নাথের এই সেবাকে বলে ছেরাপহরা।
এই বাংলার মধ্যযুগের কবি বৃন্দাবনদাস বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে সেই রীতির ছবি তুলে ধরা হয়েছে—
তবে প্রতাপ্রুদ্র করে আপনে সেবন।
সুবর্ণ-মার্জনী লঞা করে পথ সম্মার্জন।।
চন্দনজলেতে করে পথ নিষেচনে।
তুচ্ছ সেবা করে বসি রাজসিংহাসনে।।
উত্তম হঞা রাজা করে তুচ্ছ সেবন।
অতএব জগন্নাথের কৃপার ভাজন।।'
রথ টেনে আনা হয় বলগণ্ডি। জগন্নাথদেবের মন্দির ও গুণ্ডিচার প্রায় মাঝামাঝি জায়গার নাম 'বলগণ্ডি'। রথের মাঝেই এখানে বিশ্রাম নেন পূজারি, সেবকরা। বিশ্রাম নেন জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রাও। একটু খাওয়াদাওয়া হয়। একে বলে 'বলগণ্ডি ভোগ'। সেই বিশেষ ভোগে থাকে সুমধুর পানীয়, নানা ধরণের মিষ্টান্ন, খেজুর, আখ, নারকেল, কলা, প্রিয় ফল, ক্ষীরের তৈরি বিভিন্ন মিষ্টি, সুবাসিত শীতল জল, কর্পূর ও লবঙ্গ দিয়ে তৈরি সুগন্ধি মশলা পান ছাড়াও অসংখ্য উপকরণ। এর পরে গুণ্ডিচা বাড়ির দিকে চূড়ান্ত যাত্র।
এখানেই সাত দিন বাস করেন জগন্নাথ। সঙ্গে বলভদ্র ও সুভদ্রা। শুরু হয় আর এক উৎসব। গুণ্ডিচা মন্দিরের যজ্ঞবেদিতে বিগ্রহ স্থাপন করে চলে নিত্য পূজা।
তবে এর মধ্যে একটি বিশেষ দিন হল— 'হেরাপঞ্চমী'। যাত্রার চতুর্থ দিনে পঞ্চমী তিথিকে বলা হয় 'হেরাপঞ্চমী'। ওই দিন গুণ্ডিচা মন্দিরে রথভঙ্গোত্সব হয়। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের রানি ছিলেন গুণ্ডিচাদেবী। তার নামানুসারেই গুণ্ডিচাঘর বা গুণ্ডিচা মন্দির।
আষাঢ় মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিটি ‘হেরা পঞ্চমী’ নামে পরিচিত। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, সকলে রথে চেপে গুণ্ডিচা বাড়ি বেড়াতে গেলেও জগন্নাথের স্ত্রী মহালক্ষ্মী মন্দিরেই থেকে যান। এতে স্বাভাবিক ভাবেই মহালক্ষ্মী জগন্নাথের উপরে ক্রুদ্ধ হন এবং গুণ্ডিচা মন্দিরে একটি পালকিতে করে সুবর্ণ মহালক্ষ্মী রূপে এসে যত শীঘ্র সম্ভব মন্দিরে ফেরার জন্য জগন্নাথকে ভয় দেখান।
সেই সময়ে মহালক্ষ্মীকে তুষ্ট করার জন্য জগন্নাথ আবার তাঁকে ‘আজ্ঞা মালা’ (সম্মতির মালা) উপহার দেন। মহালক্ষ্মীকে ক্রুদ্ধ দেখে সেবকেরা গুণ্ডিচার প্রধান দরজাটি বন্ধ করে দেন। মহালক্ষ্মী অন্য একটি দ্বার দিয়ে প্রধান মন্দিরে ফিরে আসেন। ‘হেরা গোহরি’ নামে একটি পথ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। এরই নাম হেরা পঞ্চমী।