তাঁকে ঘিরে রহস্যের শেষ নেই। আজও মানুষ তর্কে মাতেন যিশুর ঐতিহাসিকতা নিয়ে। কেমন ছিলেন তিনি? কেমন দেখেতে ছিল তাঁকে? সত্যিই কি তিনি নাজারেথ শহরের বাসিন্দা ছিলেন? এইসব প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তর্ক ঘনীভূত হয় তাঁর ক্রুশবিদ্ধে হওয়ার ঘটনা এবং পুনরুত্থানের ঘটনা নিয়ে। হাজার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, তবু যিশুকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকা এই সব রহস্যের সমাধান হয়নি।
উপরের এই রহস্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে এমন কিছু বিষয়, যা রহস্যকে আরও বাড়িয়েছে। ‘বিষয়’ না বলে এগুলিকে ‘বস্তু’ বলাই ভাল। এক কথায় এগুলির পরিচিতি ‘যিশুর স্মৃতিচিহ্ন’ হিসেবে। ইউরোপের বিভিন্ন চার্চে-ক্যাথিড্রালে-মঠে ছড়িয়ে থাকা স্মৃতিচিহ্নগুলির সত্যতা প্রাশ্নাতীত নয়, একথা বার বার গবেষকরা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, ভক্তজনের তাতে কিছু এসে যায়নি। তাঁরা যুগ যুগ ধরে দূরদূরান্ত থেকে দেখতে এসেছেন এই সব ‘রেলিক’। আপ্লুত হয়েছেন আবেগে। স্মরণ করেছেন তাঁদের প্রিয় ত্রাণকর্তাকে।
এখানে তেমন ৫টি ‘রেলিক’-এর কথা বলা হল, যা আজও যিশু-রহস্যের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত।
১. দ্য হোলি টিউনিক— জার্মানির ট্রিয়ার ক্যাথিড্রালে রক্ষিত এক প্রাচীন আলখাল্লা। মনে করা হয়, এই পোশাকটিই ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে যিশু পরেছিলেন। এই পোশাকটি একটি অখণ্ড কাপড়ে তৈরি। তাই এটিকে ‘সিমলেস রোব’-ও বলা হয়। কথিত আছে, রোমান সম্রাট কনস্টানটাইনের মা হেলেনা এই আলখাল্লাটি জেরুজালেম থেকে নিয়ে আসেন। ট্রিয়ারে তখন কনস্টানটাইন তাঁর অভিষেকের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। রোব-টি যিশুর হোক বা না-হোক, যুগ যুগ ধরে এটাকে সযত্নে রক্ষা করে আসা হচ্ছে। আজও ট্রিয়ারের গির্জায় এই পোশাকটিকে দেখতে লক্ষ লক্ষ বিশ্বাসী খ্রিস্টান তীর্থযাত্রা করেন।
২. দ্য হোলি ল্যান্স— ‘স্পিয়ার অফ ডেস্টিনি’ বা ‘নিয়তির ভল্ল’ নামেও পরিচিত এক প্রাচীন বল্লম। বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’-এ একমাত্র সন্ত যোহনের গসপেলেই এই বল্লমের কথা রয়েছে। যিশু সত্যিই মারা গিয়েছেন কিনা যাচাই করার জন্য জনৈক রোমান সেনা এই বল্লমটি দিয়েই নাকি তাঁর দেহে খোঁচা দেয়, তখনই রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসে। সেই বল্লমটি নাকি চার অংশে বিভক্ত হয়ে ইউরোপের চারটি স্থানে রক্ষিত।
আরও পড়ুন
বড়দিনে যিশুর জন্মই হয়নি। কবে জন্মেছিলেন তিনি?
মেক্সিকোর প্রাচীন যিশু-মূর্তিতে আসল দাঁত কীভাবে এল? ভিডিও দেখুন...
রোমের সেন্ট পিটার ব্যাসিলিকা, ভিয়েনার ইম্পিরিয়াল ট্রেজারি, আর্মেনিয়ার রাজধানী ভাঘারশাপাতের একটি প্রাচীন মঠ এবং অ্যান্টিওকের সেন্ট পিটার চার্চে এই বল্লমের অংশ রক্ষিত রয়েছে বলে বিশ্বাস।
৩. দ্য ট্রু ক্রস— নামেই পরিচিতি প্রাঞ্জল। যে ক্রুশকাঠে যিশুকে বিদ্ধ করা হয়েছিল, তা নাকি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন চার্চে। রোমের সান্তা ক্রোচে ব্যাসিলিকায় সবথেকে বড় টুকরোটি রয়েছে বলে দাবি করা হয় আজও।
৪. দ্য শ্রাউড অফ তুরিন— তুরিন ক্যাথিড্রালে রক্ষিত একটি শবাচ্ছাদন। বিশ্বাসীদের ধারণা, ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পরে যিশুর দেহের উপরে এই কাপড়টিই আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই বস্ত্রখণ্ডের উপরে এক রহস্যময় মুখচ্ছবি দেখা যায়। মনে করা হয়, এটাই যিশুর প্রকৃত মুখের ছবি। অসংখ্য রহস্যোপন্যাস রটিত হয়েছে ‘শ্রাউড’-কে ঘিরে। এবং ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে করেন রহস্য-রসিকেরা।
৫. দ্য হোলি গ্রেল— ‘বিশ্বের সবথেকে রহস্যময় বস্তু’ হিসেবে পরিচিত এই পানপাত্রটির বিশেষত্ব এখানেই যে, এই পানপাত্র থেকে কেউ জল পান করলে তিনি নাকি অমরত্ব প্রাপ্ত হবেন। কারণ, বল্লমের খোঁচায় ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্তক্ষরণ শুরু হলে এই পানপাত্রে ধরে রাখা হয় তাঁর পবিত্র রক্ত। বাইবেলের কোনও গসপেলেই এই পাত্রের উল্লেখ নেই। কিন্তু, মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত একে খুঁজে ফেরেন অগণিত মানুষ। যাঁদের মধ্যে নামজাদা ঐতিহাসিক থেকে শুরু করে কুখ্যাত প্রত্নচোররাও রয়েছেন। শোনা যায়, অ্যাডলফ হিটলারও নাকি তোলপাড় করে খুঁজেছিলেন অমরত্বের এই চাবিকাঠি। ইউরোপের সাহিত্যে-নাটকে-সিনেমায় বার বার উল্লিখিত হয়েছে ‘হোলি গ্রেল’। কিন্তু আজও তা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।