‘সানন্দা টিভি’-র ‘তা বলে কি প্রেম দেব না’ ধারাবাহিকের মুখ্য চরিত্রে ডেবিউ করেছিলেন সানন্দা বসাক। তার পরে এখনও পর্যন্ত বহু ধারাবাহিকে কাজ করেছেন। ‘গোয়েন্দা গিন্নি’-তে তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। এই মুহূর্তে সানন্দা কাজ করছেন ‘স্ত্রী’ ধারাবাহিকে। অন্যদিকে এই ইন্ডাস্ট্রিতে বহুদিন ধরেই ডিওপি বা ডিরেক্টর অফ ফোটোগ্রাফি হিসেবে কাজ করছেন অভিষেক চক্রবর্তী। সানন্দা ও অভিষেকের দেখা হয়েছিল শ্যুটিং ফ্লোরে। তার পর কীভাবে জমে উঠল অভিনেত্রী ও ডিওপি-র প্রেম? এক রবিবারের আড্ডায় এবেলা ওয়েবসাইটকে জানালেন দু’জনে—
তোমাদের দেখাটা কীভাবে হল?
সানন্দা: ‘বয়েই গেল’ বলে আমরা জি বাংলা-য় একটা প্রজেক্টে কাজ করেছিলাম রবি ওঝা প্রোডাকশনসে। ওখানেই আমাদের প্রথম দেখা আর সেই দেখাটাই হয় একটু রাগারাগির মধ্যে দিয়ে। আসলে একটা সিন শ্যুট করতে গিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। ওই সিনে অনেক সিনিয়র আর্টিস্ট ছিলেন। সব মিলিয়ে এমন একটা গন্ডগোল হচ্ছিল... ডিরেক্টর আমাকে বোঝাচ্ছে, কোঅ্যাক্টররা বোঝাচ্ছে, তার মধ্যে ও খালি বলছে এই ফ্রেম নিতে পারছে না, এই ভুল হচ্ছে। আমি ওই সিনটার শেষে খুব রাগারাগি করে বলেছিলাম ক্যামেরাম্যান এত কথা বললে আমার কাজ করতে অসুবিধা হচ্ছে। তার পরেও ঝামেলাটা হতো। ও ডিরেক্টলি ঝগড়া করত না ঠিকই। আসলে ফ্লোরে যাই হোক, ফ্লোর থেকে বেরনোর পরে ও খুব কুল হয়ে যায়। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে ও আমার ভালর জন্যই বলত, একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও তৈরি হল। তার পরে ফেসবুকে একদিন আমি পিং করি। তখন থেকেই আমার ওকে একটু একটু ভাল লাগত।
আরও পড়ুন
টেলি-তারকা গোগোল ও পায়েলের প্রেমের গল্প
টেলি-তারকা সৌরভ ও মধুমিতার প্রেমের গল্প
অভিষেক, সানন্দা যখন ভুল করত, আপনি খুব রেগে যেতেন?
অভিষেক: একটু তো ইরিটেশন হতোই। আমি আমার মতো করে ফ্রেমটা সাজাতে পারতাম না। আমি ভাবতাম নতুন একজন কাজ করতে এসেছে যিনি জানেন না কী করে ফ্রেমিং নিতে হয়, পজিশন নিতে হয়। সেজন্যই আমি ওকে বলতাম, এটা ওটা। কিন্তু ও যে রেগে যেত সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আসলে আমার তখন এসব কিছু মাথাতেও থাকত না। আর ও যে ভাল-ও বাসতে শুরু করেছে সেটাও বুঝতে পারিনি। তাই ফেসবুকে যখন ও পিং করে তখন আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয়, ভাললাগাটা আসে।
এই পিং করার সময় কি প্রজেক্টটা চলছিল?
অভিষেক: হ্যাঁ, আমি প্রথম থেকেই প্রজেক্টে ছিলাম না। শুরু হওয়ার একমাসের মাথায় জয়েন করি। আসলে আমি আমার সিন সাজানোর জন্য সবাইকেই যেমন ইনস্ট্রাক্ট করতাম, ওকেও বলতাম। একটা মজার ঘটনা আছে। ও জুতো পরে সিন করছিল ফ্লোরে, যেটা করার কথা নয়। আমি ক্যামেরা অপারেট করতে করতে ওর পা’টা ধরে ফেলেছিলাম। তখন ডিরেক্টর সঙ্গে সঙ্গে বলে কাট, কাট, জুতো খুলতে হবে। পরে শুনেছিলাম, ও এটাতে খুব রেগে গিয়েছিল কারণ জুতো ছাড়া ওর হাইট শর্ট লাগে অন্যদের থেকে, অথচ ও জুতো পরতে পারছিল না।
প্রথম যখন ফেসবুকে পিং করল, আপনার কী মনে হল?
অভিষেক: আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি কে। আমি তো ওর নামও জানতাম না। আর ছবিটাও অতটা খেয়াল করিনি। প্রথমে আমার ইন্টারেস্ট ছিল না। তাও কথা বলতাম। এইভাবেই ফ্লোরের বাইরে কথা বলতে বলতে বন্ডিংটা তৈরি হয় আস্তে আস্তে।
সানন্দা, ফ্লোরের বাইরে দেখা হওয়ার উদ্যোগটা কে নিয়েছিল?
সানন্দা: বাইরে দেখা হওয়ার উদ্যোগটা অভিষেকই নিয়েছিল। আসলে কেউ তো বাচ্চা নয়, দু’জনেই বুঝতে পারছিলাম যে একে অপরকে ভাল লাগছে। ফেসবুকে অনেকদিন ধরে কথা হওয়ার পরে একদিন ও হঠাৎ করে আমাকে বলল যে এতদিন ধরে আমাদের কথা হচ্ছে, আমার ফোন নম্বর তো কোনওদিন চাসনি। আমি বললাম আমি চাইনি কারণ সবটা কেন আমি করব। তার পরে কথা ওঠে যে একদিন বাইরে দেখা করলে কেমন হয়। তার পরে অভিষেক আর আমি একটা মুভি দেখতে যাই।
এটা কতদিন আগে?
সানন্দা: এইটা ধরো ২০১৩।
তখন কি তোমরা ভেবেছিলে যে এই রিলেশনশিপটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাববে?
সানন্দা: একদমই, আমাদের কোনও কিছুতেই বেশি সময় লাগেনি। আমাদের ওই প্রজেক্টে প্রত্যেকদিন রাত হতো না। দু’জন যখন ফেসবুকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কথা বলতাম মাঝরাত পর্যন্ত, দু’জনেই বুঝতে পারছিলাম যে একে অপরের প্রতি ইন্টারেস্ট আছে। দেখা করার পরে ব্যাপারটা আরও গভীর হয়। আমরা শুধু বন্ধু কোনওদিনই ছিলাম না। আর দেখা করার পরে টানটা আস্তে আস্তে আরও বাড়ল।
তোমাদের এই টানটা সিরিয়ালের সেটে কেউ বুঝতে পারেনি?
সানন্দা: না, না একদমই কেউ বুঝতে পারেনি। আমরা প্রথমে রেজিস্ট্রি করি আর তার কয়েক মাস বাদে রিসেপশনটা হয়। আমরা সমস্ত রিচুয়াল মেনে ঠিক বিয়ে করিনি। রেজিস্ট্রির সময় অনেক কম জন নিমন্ত্রিত ছিলেন। তখন আমরা পুরো ইউনিটকেও বলিনি। যখন বউভাতের নিমন্ত্রণ করতে গেলাম, তখন পরাণজেঠুর (পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) কথাই ধরি, উনি অভিষেককে জিজ্ঞাসা করেন ‘সানন্দা কি আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কেউ?’। আমার ‘বয়েই গেল’ সিরিয়ালের নাম ছিল ‘পলা’। সেটা বলতে উনি অবাক হয়ে বললেন ‘ও পলা’?— এই রকম আর কী। আমাদের ইউনিটে তখন প্রেমের ব্যাপারটা জানত গোনা কয়েকজন। যেমন মৈত্রেয়ীদি, রত্নাদি, চিত্রাদি, ওঁরা জানতেন। আর ছেলেদের মধ্যে রোহিত আর সৌরভ দাস জানত কারণ ওরা একই বয়সী বলে বন্ধুর মতো ছিল। তাছাড়া অভিষেকের একটা ব্যাপার আছে, ও যখন ফ্লোরে ঢোকে তখন একদম অন্য মানুষ হয়ে যায়। নিজের কাজের বাইরে কিছু জানে না।
অভিষেককে ঠিক কী কারণে তোমার আইডিয়াল পার্টনার মনে হল?
সানন্দা: ওর প্রচণ্ড ধৈর্য। আমার আগে এত ধৈর্য ছিল না, ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়েছে। ওর মধ্যে একটা স্থিরতা রয়েছে যেটা আমাদের প্রফেশনে সব সময় থাকে না। আর ওর খুব ঠান্ডা মাথা। টেনশনটা নিজের মধ্যে রাখতে পারে। আমি বরং মাঝেমধ্যে চিৎকার-চেঁচামচি করে ফেলি এবং সেটা অনেকটাই অহেতুক। প্রথমত ও সেই সব বিষয়ে প্রচণ্ড অ্যাডজাস্ট করে আর দ্বিতীয়ত, ও ভীষণ হেল্পফুল। অনেকেই বলে যে ভাগ্য করে হাজব্যান্ড পেয়েছিস। আর মেয়ে হওয়ার পরে সব কাজই আমরা ভাগ করে করেছি। শুধু ও নয়, ওর ফ্যামিলির ক্ষেত্রেও আমি প্রচণ্ড সাপোর্ট পেয়েছি।
অভিষেক, সানন্দাকে আলাদা করে ভাললাগার কী কারণ ছিল?
অভিষেক: প্রথম থেকেই দেখেছিলাম যে কাজের প্রতি ওর ডেডিকেশনটা মারাত্মক। ও একজন মেয়ে হয়েও নিজের জীবনটা একটু আলাদা করে দেখে, আর কিছু জায়গায় ও খুব পজিটিভ। আমি আগে খুব ইনসিকিওরড থাকতাম কাজ নিয়ে। কিন্তু ওর মধ্যে দেখতাম একটা পজিটিভ অ্যাটিটিউড রয়েছে সব সময়। আর ওর মাথাটা খুব শার্প। শুধু প্রফেশনে নয়, বাড়ির সব কাজেই খুব পারফেক্ট। আমি বরং অনেক কাজ ঘেঁটে ফেলি। ও একা হাতে সব কিছু সামলে নেয় আর খুব স্পিডে করে ফেলে।
সানন্দা একদম দশভুজা তো তাহলে...
অভিষেক: একদমই। আমার মেয়ে হওয়ার পরে আমার মা-ও ভয় পেয়েছিল একটু কারণ অনেকদিন তো বাচ্চা সামলায়নি। সানন্দা কিন্তু সব নিজেই করেছে। আমাদের কোনও আয়া ছিল না ৯ মাস অবধি। আমি খুব ভয় পেতাম যাতে ঘাড়ে লেগে না যায়। ও কিন্তু সব সামলাত। ওর মনের জোরটা মারাত্মক। বেবি হওয়ার ছ’দিনের মধ্যে একটা নন-ফিকশন শো-তে গিয়েছিল।
সানন্দা: ডেলিভারি হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যেই আমাকে ফোন করে বলা হয় যে তুই পাঁচ ঘণ্টার জন্য আসতে পারবি? আমি পাম্প করে দুধ-টুধ রেডি করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মেয়ের একমাস বয়স থেকে আমি শো করেছি, অ্যাওয়ার্ড শো-তেও পারফর্ম করেছি। সবাই বলেছে, তোমার দেড়মাসের বাচ্চা তুমি পারফর্ম করবে? আমি বললাম হ্যাঁ ডাক্তার পারমিশন দিয়েছে। তারপর ঠিক সাড়ে তিনমাসের মাথায় কালার্স বাংলায় ‘মা দুর্গা’ সিরিয়াল জয়েন করি। সেটা একবছর কন্টিনিউ করেছিলাম। আবার তার মাঝখানেই ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ শুরু হয়েছে। অভিষেক: হ্যাঁ, ‘বয়েই গেল’-র পরে ‘গোয়েন্দা গিন্নি’-তেই আমরা আবার একসঙ্গে কাজ করেছি।
এই যে প্রফেশনাল ও পার্সোনাল স্পেস একসঙ্গে শেয়ার করার বিষয়টা... এর ভাল দিক আর খারাপ দিক কী কী বলে মনে হয়?
অভিষেক: আসলে আমাদের প্রফেশনে আলাদা আলাদা প্রজেক্টে কাজ করলে দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হয়ই না কারণ বেশিরভাগ সময় কলটাইম আলাদা থাকে। যেহেতু একসঙ্গে কাজ করি তাই অন্তত ফ্লোরের মধ্যে একসঙ্গে দেখাটা হয়, সেটা একটা ভাল দিক। আর খারাপ দিকটা হল এই যে মাঝেমধ্যে আওয়াজ শুনতে হয়... তোরা প্যাকেজে কাজ করিস?
সানন্দা: আমার বন্ধু সৌরভ মানে অভিনেতা সৌরভ দাস ঝিনুক হওয়ার পরে বলেছিল ওর আর্টিস্ট ফোরামের কার্ডটা করিয়ে রাখতে। আমি বলেছি যে না আমার মেয়ে ডিরেক্টর হবে। সেটা শুনে বলল, মা হিরোইন, বাবা ডিওপি, মেয়ে ডিরেক্টর... তোরা সিনেমা কর আর সিনেমার নাম দিবি ‘বাকিটা ফ্যামিলিগত’... খারাপ দিক অ্যাজ সাচ কিছু নেই। তবে মাঝেমধ্যে ধরো আমি একটা ভুল পজিশন নিলাম আর ও অ্যাডজাস্ট করে নিল, তখন একটু আওয়াজ শুনতে হয়। আবার হয়তো আমার শট আছে, তখন সবাই মজা করে বলল, ও বাবা, এখন ক্যামেরাম্যানের বউয়ের শট বাবা, আমরা যাই।