‘নান বাট দ্য ব্রেভ ডিজার্ভস দ্য ফেয়ার’— কৈশোরে ইংরেজি প্রবাদবাক্যের লিস্টিতে পড়া এই প্রবাদটি দীর্ঘকাল ধরে ভাবিয়েছে। এই ইংরেজি কনোটেশন নয়, বাংলায় এই বাক্যের অর্থ কী। ‘ফেয়ার’ শব্দের অন্যতম আভিধানিক অর্থ ‘ফরসা’। তা হলে কি ফরসা মেয়ে বিয়ে করতে গেলে ‘ব্রেভ’ মানে ‘বীর’ হতে হবে? ওদিকে বাঙালির আর যাই থাকুক, ‘বীরত্ব’ ব্যাপারটা বরাবরই একটু ঢিলে। তাহলে কি বাঙালির ভাগ্যে ফরসা মেয়ে নেই? সেই কারণেই কি প্রতি রবিবার ‘পাত্রী চাই’ স্তম্ভে ‘ফরসা’ পাত্রী পাওয়ার জন্য এত আকুতি? এই সব কূট ও আধা-দার্শনিক প্রশ্নে মাথা ভারী হয়ে আসে। থই মেলে না।
তারাশঙ্কর বাঁড়ুজ্যে বোল্ডলি লিখেছিলেন— ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’। স্বয়ং রবিঠাকুর দিয়ে গিয়েছেন— ‘কালো, তা সে যতই কালো হোক’ (মানে, কালো মেয়ের কালোত্ব মানিয়ে নাও বাপি, ফরসা ফরসা করে জ্বালিও না)। তা ছাড়া কলীভক্ত বাঙালি শত শত শ্যামাসঙ্গীতে ‘কালো মেয়ে’-র গুণ গেয়েছে। তাতেও যে ফরসা মেয়ের প্রতি বঙ্গপুরুষের হাঁকার কমেনি, তা প্রতি রবিবারের ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনেই প্রমাণিত। সেই কবে থেকে মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের সেজদি-ছোড়দির দল রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মাখার অভ্যাস তৈরি করেছিল, তার পর তা কবে যে বাঙালি মেয়ের জিন মানচিত্রে ঢুকে গিয়েছে, তার হিসেব নেই। কিন্তু গত বছর পনেরোয় এই হিসেবটা একটু টাল খেয়েছে বলে মনে হয়।
না, এর মানে এই নয় যে বাঙালি মেয়েরা ফেয়ারনেস ক্রিম মাখা বন্ধ করে দিয়েছে। সে সব যথাস্থানেই রয়েছে। মোটামুটি ভাবে মিলেনিয়ামের বছর থেকেই বাজারে আসতে শুরু করে পুরুষদের জন্য ফেয়ারনেস ক্রিম। এর আগে পুরুষের একান্ত প্রসাধনীর তালিকায় ছিল শেভিং ক্রিম, আফটার শেভ লোশন। খুব বেশি হলে ডিও। কিন্তু গত দেড় দশকে এই সমস্ত কিছুকেই টেক্কা দিয়েছে পুরুষের জন্য ফেয়ারনেস ক্রিম। এটা কি নব্য ফেমিনিজমের জয়? উল্টে গেল নাকি জেন্ডার-বৃত্তান্ত— মেয়েরা কি কোথাও নিভৃতে দাবি করলেন, তাঁরাও ফরসা পুরুষ পাত্র ছাড়া বিয়ে করবেন না? কই, তেমন বিজ্ঞাপন তো চেখো পড়েনি ‘পাত্র চাই’ কলমে?
এক জাঁকালো বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্ণধার জানিয়েছেন, বাজারে এতকাল ধরে বিক্রিত মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট ফেয়ারনেস ক্রিমের এক তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারীই ছিলেন পুরুষ। এই মহাসত্যটি বাজার-জরিপ থেকে জেনে নিয়েই নাকি পুরুষের ফরসা হওয়ার ক্রিম তৈরিতে রত হয় নামজাদা কসমেটিক কোম্পানিগুলি। মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিস্টরা তৈরি বাজারটাকে কেবল সামান্য ঘুরিয়ে দেন। ২০১৫ সালের প্রসাধনী সামগ্রীর মধ্যে মেল স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টই যে ডমিনেট করে তা নিম্নলিখিত হিসেবে জানিয়েছে ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনাল—
সারা ভারতের এই ছবিটা কিন্তু বাংলায় যাকে বলে জমে ক্ষীর। কলকাতার প্রসাধনী সংস্থা ইমামি-র পুং ফরসা হওনের অ্যাডে দুদ্দার উঠে আসেন শাহরুখ খান, হৃতিক রোশন। মুম্বই মশালা এসে লাগে কালিয়াচক, কি হিঙ্গলগঞ্জে। হিসেব দেওয়া মুশকিল, তবে এটা ওয়াকিবহাল ব্যক্তি মাত্রেই জানেন, বাংলার গ্রাম-গঞ্জের ছোট-খাটো পান-সিগারেটের দোকানে পর্যন্ত পুং ফেয়ারনেস প্রোডাক্টের রমরমা। শুধু দীর্ঘমেয়েদি ফরসা হওনের মুষ্টিযোগ নয়, ‘ইনস্ট্যান্ট ফরসা’ হওয়ার উপায় চলে আসে হাতের মুঠোয়। এমন ফেসওয়াশ বাজারে আসে, যার বিজ্ঞাপন প্রায় এই কথা বলে— মুখ ধুলেই ফরসা।
এখানে প্রশ্ন জাগে, এই দ্রুত ফরসা হওয়ার জন্য ভারতীয় পুরুষের উপরে চাপ দিল কে? অনেক সমাজবিদই মনে করেন, ইংরেজ আগমনের আগে ভারতীয়দের মধ্যে ফরসা হওয়ার তেমন হিড়িক ছিল না। এটা একান্তই একটা পোস্ট-কলোনিয়াল সিনড্রোম। কালীদাস ‘তন্বীশ্যামাশিখরিদশনা’ সুন্দরীর ফর্মুলা রেখেছেন। ফলত, ট্র্যাডিশনাল মার্কেটে মেমাগমনই একমাত্র কারণ এই ফরসা-ক্রেজের। কিন্তু এটা কেউ ভেবে দেখেন না যে, আমাদের দেবীমূর্তিগুলির অধিকাংশই তপ্তকাঞ্চনবর্ণা। শনি বা ওই কিসিমের কিছু লোকায়ত দেবতা বাদ দিলে পুং দেবতারাও ফরসাই। কেষ্ট-বিষ্টু-রামকে ‘নবদুর্বাদলশ্যাম’ বোঝাতে এক্কেবারে নীলবর্ণ শৃগাল করে ছেড়েছে ভারতীয় আর্ট। বাকি পাবলিক ফরসাই। ‘দেবদুর্লভ তনু’ বলে বাজারে যে কনসেপ্ট চালু রয়েছে, তার অন্যতম ইনগ্রেডিয়েন্টই ফরসা গাত্রবর্ণ। জাতপাতের বিভাজনেও ‘কালো বামুন’ বেশ নিন্দিতই থেকেছেন প্রবাদে-কহাবতে। তা হলে সায়েবদের নামে কেন দোষারোপ?
বাঙালি পুরুষের তথা ভারতীয় মর্দের কনসেপ্টে ‘ডার্ক টল অ্যান্ড হ্যান্ডসাম’ কখনই তেমন আদৃত হয়নি। ভারতীয় পুরুষ বিবাহে আন্তর্জাতিক হলেও সাধারণত ছোঁয়াচ বাঁচান আফ্রো-উৎসের মানুষের। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে রীতিমতো হিংসার শিকার হয়েছেন বেশ কিছু কৃষ্ণবর্ণের মানুষ। ‘কালো মানুষের দেশ’ ভারতে আফ্রো অরিজিনের মানুষকে অনায়াসে ‘কালুয়া’ বলে সম্বেধন করা যায়। ধর্মীয় সংঘাত নিয়ে ভারতীয় পরিসারে উথলে ওঠা আবেগ ঢেউ খেলে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু, এই বর্ণান্ধতা নিয়ে সরব হতে দেখা যায় ক’জনকে? সুতরাং নন্দিতা দাসকে দিয়ে বিজ্ঞাপন করিয়ে ‘কালো মেয়ে’-র সৌন্দর্যকে তুলে ধরার যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, আম ভারতীয়, আম বাঙালি ফরসা হওয়ার পিছনে ছুটবেই। কিন্তু তা-ও এ কথার উত্তর সহজে মেলে না, কেন পুরুষের পরসা হওয়ার জন্যে আকুতি বেড়ে গেল গত ১৫ বছরে। মনে রাখা দরকার, এই মুসাবিদার গোড়াতেই বলা হয়েছে— মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট ফেয়ারনেস ক্রিমের এক তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারীই ছিলেন পুরুষ। এই ধামাকা এই কালের গর্ভেই ছিল সাপ হয়ে তক্ষক হয়ে, তাকে গডজিলায় পরিণত করেছে বলিউড, করেছে রঙিন টেলিভিশনের প্রসার। সাদাকালো জমানা থেকে বোকাবাক্সের রঙিন হওনে পুরুষ অভিনেতার কাঁচাসোনা রং যেভাবে ভারতীয় অন্দরমহলে ঘাই মারে, তাতে কেউ মেকআপ আর লাইটের গল্পটাকে ভেবে দেখার অবকাশই পাননি। তার উপরে গ্রুমিং নামে যে একটা বস্তু এই রং বদলের পিছনে ক্রিয়াশীল, তা তেমনভাবে প্রচারিতই হয়নি। বাঙালি পুরুষ, ভারতীয় মর্দানা ভেবেছে, গোরি তেরা গাঁও বড়া পেয়ারা। কালা তো বুরি নজরওয়ালের মুখ। বিজ্ঞাপন বলেছে— ‘ফেয়ার বনো, ফেয়ার চুনো’। এর মানে যদি এমন দাঁড়ায়— নিজে ফরসা হও, তবে ফরসা ‘বেইবি’ পাবে, তবে কিছু বলার নেই। রাতে শুতে যাওয়ার আগে অপুষ্টিতাড়িত ভারতবর্ষ, পেটে কিল মারা ভারতবর্ষ, পণের আগুনে পুড়ে যাওয়া ভারতবর্ষ, তিনতালাকে ছিন্নভিন্ন ভারতবর্ষ কেবল ফেয়ারনেস ক্রিম মেখে পৌঁছে যাবে ‘অচ্ছে দিন’-এ। জয়হিন্দ! বন্দেমাতরম!