১৯৮৪ সালে ২টি আসন থেকে ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রে সরকার গড়া। ১৯৯৬ সালে প্রায় ৭ কোটি ভোট থেকে ১৯৯৮ সালে প্রায় সাড়ে ৯ কোটি ভোট পেয়ে পাঁচ বছরের জন্য প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকার চালানোর কৃতিত্ব অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছিল।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ছাপিয়ে গিয়েছেন বাজপেয়ী জমানাকেও। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি সংখ্যালঘু হলেও, মোদী কিন্তু চালাচ্ছেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার। ২০১৪ সালে বিজেপির ঝুলিতে এসেছে প্রায় ১৭ কোটি ভোট, যা একটি রেকর্ড। সারা দেশের অন্তত ২২টি রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়েছে বিজেপি।
অটলবিহারী যদি লালকৃষ্ণ আডবাণীর হাত ধরে এতটা পথ পেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তো মোদীর রয়েছেন বিশ্বস্ত সেনাপতি অমিত শাহ।
এতটা সফল হয়েও, মোদী কেন বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনায় পরাজিত হয়ে যান বার বার? মূলত দু’টি কারণেই মোদী আলাদা হয়ে যান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর থেকে।
আসলে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ‘নিরাপত্তাহীনতা’ ও দিল্লির সংসদীয় রাজনীতির অনভিজ্ঞতাই তাঁকে পিছিয়ে দেয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর থেকে।
বাজপেয়ীর সহযোগী, মন্ত্রিসভা ও দলের সহকর্মী, এমনকী বিরোধী দলগুলির নেতাদের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন, বিরোধীদের আলোচনার টেবিলে বসানোর আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর। তাঁর রাজনীতি ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক’ ছিল না। তাঁর রাজনীতি ছিল ‘মানুষ-কেন্দ্রিক’।
কংগ্রেস হোক বা কমিউনিস্ট, নিজের দল হোক বা শরিক দল, কাশ্মীর হোক বা পাকিস্তান, হিন্দু কট্টরপন্থী হোক বা মুসলমান সম্প্রদায়— আলোচনায় যুক্ত করে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস বাজপেয়ী বরাবর করে গিয়েছেন। সুফলও পেয়েছেন। গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে তাঁর।
তাঁর আমলে দলে বা সরকারে মতবিরোধ থাকলেও গণতান্ত্রিকতার অভাব ছিল, এরকম অভিযোগ কেউ তুলতে পারেন না। গেরুয়াকরণের অভিযোগ উঠলেও, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়নি বিপরীত শিবিরের মানুষকে।
উলটো দিকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগই হল তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করেছেন। কেউ তাঁর সামনে বিরুদ্ধ মত রাখতে ভয় পান। বিরোধী শিবিরের সঙ্গে তিনি সখ্য বজায় রেখে কঠিন সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন, এমন সুনাম তাঁর পরম বন্ধুরাও মোদী সম্বন্ধে করতে পারবেন না।
তিনি আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী। তিনি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। এমনই পরিচয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর।
আসলে সেই ১৯৫৭ সাল থেকে জাতীয় স্তরে সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা, কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হওয়া, নেহরুর সময় থেকে প্রধানমন্ত্রীদের দেখা— এ সবই বাজপেয়ীকে পোক্ত করেছিল একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে। তাঁর ‘হেরে’ যাওয়ার ভয় ছিল না। তাই উদাত্ত কণ্ঠে বিরোধীদের প্রশংসা করতে ভয় পেতেন না।
অন্যদিকে জাতীয় স্তরে বেশ কিছুদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নরেন্দ্র মোদীর বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে একটি অঙ্গরাজ্যে। সেখানে যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ করে সরকার চালিয়েছেন, কেন্দ্রেও সেই একই মডেল অনুসরণ করেছেন তিনি। যা আপাত ভাবে কাজে দিলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সহকর্মী বা বিরোধীদের দূরত্ব বাড়িয়েছে অনেক।
একদিকে যেমন জাতীয় স্তরে সংসদীয় রাজনীতির অভিজ্ঞতার অভাব তাঁকে নির্বাচনে হেরে যাওয়া অরুণ জেটলীকে মন্ত্রিসভায় আনতে বাধ্য করেছিল, অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদীর নিরাপত্তাহীনতা তাঁকে এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘একনায়কতন্ত্রের’ মূর্তি তুলে ধরতে বাধ্য করেছে।
বাজপেয়ী কোনও অংশে মোদীর থেকে কম হিন্দুত্ববাদী ছিলেন না। আডবাণী তো দুঃখ করে বলেনই, তাঁকে কট্টরপন্থী বললেও বাজপেয়ীকে নরমপন্থী কেন বলা হয়? তাঁরা তো একই পথের পথিক ছিলেন!
কিন্তু বাজপেয়ীকে ফেজ টুপি পরতে বা মাজারে চাদর চড়াতে দু’বার ভাবতে হয়নি। সেটা নাটকও মনে হয়নি। কারণ বাজপেয়ীর মুখের কথা ও কাজে তা করে দেখানোর সাহস বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে সাধারণের।
গেরুয়া শিবিরের এক তাত্ত্বিক নেতা অবশ্য ঠিকই বলেছেন, ‘‘দু’জনের তুলনা করতে যাবেন না। দু’জনের ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি ভিন্ন।’’
২০০৪ সাল থেক ২০১৪ সাল। মাত্র ১০ বছরে পরিস্থিতি কতটা ভিন্ন হয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বিজেপি নেতারাও। ভাগ্য ভাল, অটলবিহারী বাজপেয়ীর অসুস্থতার কারণে ‘স্মৃতিশক্তি’ লোপ পাওয়ায় তাঁকে সেই পথের ‘মার্গদর্শক’ হতে হয়নি। পরিস্থিতি আরও ‘ভিন্ন’ হওয়ার আগেই তিনি প্রয়াত হলেন। একপ্রকার বেঁচেই গেলেন।