কৃষক ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির সমর্থনেই তিন রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনে পাশা উলটে গিয়েছে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিজেপি সরকারের উপর চাষিদের রাগের কারণ আছে, তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। দেশের কৃষকদের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে তাও কেউ অমান্য করতে পারবেন না।
কিন্তু জয়ের জন্য এই কৃষক শ্রেণিকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া তাঁদের ঋণ মকুব করে দেওয়ার মধ্যে যে উপর-চালাকি আছে। তাও মানতে হবে।
২০০৮ সালেও প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় কংগ্রেস কৃষকদের বলে দিয়েছিল আর ঋণ শোধ করতে হবে না। তাতে কাজ হয়েছিল বলেই নির্বাচনী পাটিগণিতে দেখা যায়। একই সুরে বর্তমান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী আবার বলছেন যতক্ষণ না কৃষকদের ঋণ সরকার মিটিয়ে দেয়, ততক্ষণ তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ঘুমতে দেবেন না।
তার মানে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালে কৃষকদের যা অবস্থা ছিল, আজ ১০ বছর পরে একই অবস্থা রয়েছে তাদের। কারণ তখন কৃষকদের ঋণ মকুব করেও তাঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি এতদিন হয়নি। আজও হবে না।
এর জন্য শুধুই যে রাহুল গাঁধীরা দায়ী তা নয়। আর কৃষি ঋণ মকুব যে শুধু কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকারই করছে তা নয়। উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে একই কাজ করেছে বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার।
রাহুল গাঁধী ঠিক কী বলেছেন, শুনে নিন একবার:—
কারণটা এটাই যে দেশের কৃষকরা সত্যিই দুরবস্থার মধ্যেই রয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি কৃষক মিছিল ও বিক্ষোভেই স্পষ্ট হয়েছে তাঁদের ক্ষোভের আওয়াজ বাড়ছে।
সেই দুরবস্থা থেকে কৃষকদের উদ্ধার করতে কৃষি ঋণ মকুব একটি পথ মাত্র। তাতেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপকৃত হন বিত্তবান চাষি ও কিছু কর্পোরেট সংস্থা। ২০১৫ সালের একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে কৃষকদের জন্য তৈরি করা ব্যাঙ্ক নাবার্ড ৭০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে কৃষি বাণিজ্যে যুক্ত সংস্থাকে।
কৃষি ঋণ মকুবে প্রান্তিক চাষিদের বা ভাগ চাষি এবং চাষের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের কতটা সুবিধা হয় তা নিয়ে রাজনীতিকরা বিশেষ ভাবিত নন।
চাষিরা ফসলের সঠিক দাম না পেয়ে, মহাজনদের কাছে ফেঁসে গিয়ে, ফসল বেচতে না পেরেই কষ্টে পড়েন। কখনও প্রাকৃতিক বা অন্যান্য কারণে ফলনও ভাল হয় না। তার উপর যুক্ত হয়েছে নোটবাতিলের মতো বিভীষিকা। কাঁচা টাকায় যে গ্রামীণ অর্থনীতির লেনদেন হতো, তা প্রায় বন্ধ হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বীজ, সার ও চাষের অন্যান্য খরচ। গত কয়েক বছরে তা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।
অর্থাৎ উৎপাদনের খরচ বাড়লেও, বাড়েনি ফসল থেকে আয়ের পরিমাণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকার ন্যূনতম দাম বেঁধে না দেওয়াতে লোকসানের মুখে পড়ছেন চাষিরা। বাজেটে ঘোষণা হয়েছে বটে পাঁচ বছরে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই জটিল অঙ্কে কত জনের আয় বাড়বে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
রাহুল গাঁধীকে কী ভাবে আক্রমণ করল মোদী সরকার। শুনে নিন নীচের ভিডিওটিতে:—
ফলে এই বছর হয়তো ঋণ শোধ করতে হবে না। কিন্তু তার পরে? একটি কৃষি নির্ভর দেশে কৃষি কাজের সামগ্রিক পরিকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কৃষকদের জন্য সুবিধা না আনলে ধীরে ধীরে কৃষি কাজ থেকে সরে যাবেন চাষিরা। উলটো দিকে তো কর্মসংস্থানের বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায়, তাঁরা বেকার হবেন। দেশের খাদ্য সুরক্ষা মাথায় উঠবে।
আর ভাবটাও এমন যেন, ব্যাঙ্কগুলিকে সরকার এই টাকা নিজেদের পকেট থেকে দেবে। অন্য কোনও উপায়ে তো এই হাজার হাজার কোটি টাকা সেই মধ্যবিত্ত, কৃষক, গরিবদের পকেট থেকেই সুদে আসলে আদায় করবে সরকার।
একদিকে কৃষকদের এই ‘পাইয়ে দেওয়ার’ রাজনীতি করে না তো কৃষকদের উপকার করছে রাজনৈতিক দলগুলি, অন্যদিকে এই শ্রেণির সামগ্রিক উন্নতির কথা না ভেবে বরং একটি বিপদ ডেকে আনছে। যেমন ভাবে তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের সংরক্ষণ করেও তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। তেমন এই ঋণ মকুব করেও কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষকদের কোনও উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
ফলে রাজনীতিকরা এখনই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানের রাস্তা খুঁজুক। নয়তো সব পক্ষের জন্যই বিপদ বাড়বে।