সতীর্থরা সকলে যখন পরিবারের সঙ্গে দীপাবলি উদযাপন করছেন, তিনি বাড়ি থেকে অনেক দূরে। বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। উৎসবের আবহেও মগ্ন ক্রিকেট সাধনায়। সামনেই যে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরীক্ষা! কঠোর প্রস্তুতির ফাঁকে ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা স্পিন-অস্ত্র যুজবেন্দ্র চাহাল সময় দিলেন ‘এবেলা খেলা’কে। আজ, শুক্রবার মুম্বইয়ে জাতীয় শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। তার আগে মোবাইল ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ২৭ বছরের লেগস্পিনার শোনালেন তাঁর স্বপ্ন আর সংকল্পের কথা।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শেষ হওয়ার পরই হাজির নিউজিল্যান্ড। মানসিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন নিশ্চয়ই?
যুজবেন্দ্র চাহাল: শুধু মানসিক প্রস্তুতি নয়, নেটেও পুরোদমে প্র্যাক্টিস করছি। ফিটনেস ট্রেনিংও চলছে। এইমাত্র নেটে বল করে ফিরলাম। বলতে পারেন নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য আমি পুরোপুরি প্রস্তুত।
প্রশ্ন: আপনি এখন কোথায় প্র্যাক্টিস করছেন?
চাহাল: বেঙ্গালুরুতে। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য।
প্রশ্ন: মানে ক্রিকেটারদের প্রায় সকলেই যখন পরিবারের সঙ্গে দীপাবলির ছুটি কাটাচ্ছেন, আপনি তখন বাইশ গজের জগতেই আবদ্ধ?
চাহাল: হ্যাঁ। কারণ, আমি এখন ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নিয়ে ভাবছি না। দীপাবলির জন্য সকলকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। কিন্তু নিজে উৎসব থেকে আপাতত একটু দূরেই থাকতে চাই। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। সেটাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে চাই। বল হাতে একটা ছাপ ফেলতে পেরেছি। আগামী সব ম্যাচে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
প্রশ্ন: প্রতিশ্রুতিমান দাবাড়ু থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা— আপনার জীবনের মোড় তো অলৌকিকভাবে ঘুরে গিয়েছে?
চাহাল: ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমি দু’টো খেলাই সমানতালে চালিয়ে গিয়েছি। সেই সময়ে অবশ্য দাবাই আমার প্রিয় স্পোর্টস ছিল। ছবিটা বদলে যায় ২০০৩ বিশ্বকাপের পর থেকে। দু’টো খেলা চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি ২০০৩ বিশ্বকাপে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় দলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সারা দেশে ক্রিকেট নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, আমিও তাতে ভেসে গিয়েছিলাম। ক্রিকেটকেই বেছে নিলাম। ২০০০ সালে মাত্র দশ বছর বয়সেই হরিয়ানার অনূর্ধ্ব ১৪ দলে খেলেছিলাম। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর আরও গুরুত্ব সহকারে ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। হরিয়ানার অনূর্ধ্ব ১৬ দলের হয়ে বেশ ভাল পারফর্ম করি। সেই থেকে ক্রিকেটই আমার ধ্যান-জ্ঞান। তারপর হরিয়ানার অনূর্ধ্ব ১৭, অনূর্ধ্ব ১৯ ও অনূর্ধ্ব ২৫ দলের হয়ে সাফল্য পাই। টানা সাত বছর ধরে রঞ্জি ট্রফি খেলেছি। আইপিএলেও ছাপ ফেলতে পেরেছি।
প্রশ্ন: ক্রিকেট মাঠে আপনার প্রথম শিক্ষক কে?
চাহাল: অনেকেই আছেন। হরিয়ানায় রণধীর সিংহ চোধুরীর কাছে প্র্যাক্টিস করতাম। তবে কোনও অ্যাকাডেমিতে যাইনি কখনও। হরিয়ানার জিন্দ-এ আমার পাড়ায় বন্ধুরা মিলে ক্রিকেট খেলতাম। তবে স্পিন বোলিংয়ের প্রতি ভালবাসা বাড়িয়ে তুলেছিলেন মনিন্দর সিংহ ও নরেন্দ্র হিরওয়ানি স্যার। জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে দু’জনের কাছেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার বাবা কৃষ্ণকুমার চাহাল পেশায় আইনজীবী হলেও নিজে ক্রিকেট খেলতেন ছোটবেলায়। খেলাটাকে অসম্ভব ভালবাসেন। আমি ছোটবেলা বাবার তত্ত্বাবধানেও প্র্যাক্টিস করতাম।
প্রশ্ন: দাবা মানেই মনঃসংযোগের খেলা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ক্রিকেটার যুজবেন্দ্র চাহালের জীবনে দাবাড়ু যুজবেন্দ্র চাহালের প্রভাব কতটা?
চাহাল: দাবা ধৈর্যের খেলা। ছোটবেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দাবা খেলতাম বলে মনঃসংযোগ বেড়েছে। ক্রিকেট মাঠেও তার সুফল পাই। ম্যাচে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন লম্বা স্পেলে বোলিং করলেও উইকেট পড়ে না। তখন ধৈর্যের প্রয়োজন হয় খুব। দাবা খেলার জন্যই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারাটা আমার সহজাত হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: ব্যাটসম্যানেরা রিস্টস্পিনারদের আক্রমণ করতে পছন্দ করে। চার-ছক্কা হজম করার আশঙ্কাও থাকে। সেরকম পরিস্থিতিতে কী করেন?
চাহাল: উইকেট নেওয়ার জন্যই বোলিং করি বরাবর। তার জন্য আক্রমণাত্মক লাইন-লেংথে বল করি। কোনও ব্যাটসম্যান আগ্রাসী হয়ে শট খেলতে শুরু করলে তাকে আউট করার সুযোগও বেশি থাকে। তবে আমরা আগে ব্যাটিং করলে দেখে নিই হাতে কত রানের পুঁজি আছে। সেই অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি ঠিক করি।
প্রশ্ন: বিরাট কোহলির নেতৃত্বে আইপিএলে খেলেন। জাতীয় দলেও অধিনায়ক হিসাবেও কোহলিকে পাচ্ছেন। আপনার সাফল্যের নেপথ্যে বিরাটের ভূমিকা কতটা?
চাহাল: বিরাট খুব সাহায্য করে। সে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর হোক কী জাতীয় দল। আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। কখনও নির্দেশ দেয় না যে, এভাবে বল করতে হবে। বল হাতে দেওয়ার সময় বলেই দেয়, নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী বোলিং কর। বিরাট চায় আমি আক্রমণাত্মক লাইনে বল করি, উইকেট নেওয়ার জন্য বল করি। আগ্রাসী ক্রিকেট খেলাই ওর মন্ত্র। ক্যাপ্টেন এরকম সমর্থন করলে মানসিকভাবে যে কেউই চাঙ্গা থাকবে। আর শুধু বিরাট কেন, মাহি (মহেন্দ্র সিংহ ধোনি) ভাইও খুব সাহায্য করে।
প্রশ্ন: কীরকম?
চাহাল: উইকেটকিপার হওয়ায় মাহি ভাই বুঝতে পারে, কোন ব্যাটসম্যানকে কোথায় বল করা উচিত। সেই মতো পরামর্শ দেয়। তাতে দারুণ সাফল্যও পাই। মাঠে কারও চারপাশে এত সাহায্যকারী হাত থাকলে অনেক আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়।
প্রশ্ন: কুলদীপ যাদবের সঙ্গে আপনার পার্টনারশিপ প্রতিপক্ষ শিবিরের ঘুম উড়িয়ে দিচ্ছে। কী বলবেন আপনাদের জুটি নিয়ে?
চাহাল: কুলদীপের সঙ্গে আমার দারুণ বোঝাপড়া। অক্ষর পটেলের নামও উল্লেখ করতে চাই। আমরা তিনজন মাঠের বাইরেও ভাল বন্ধু হয়ে গিয়েছি। তিনজনেই জানি, কে কীভাবে বল করবে। সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করি। ম্যাচে হয়তো তিনজনের মধ্যে একজনকে বসতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনও লড়াই নেই। বরং তিনজনই একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা করি বোলিং নিয়ে। ব্যাটসম্যানের কোনও দুর্বলতা চোখে পরলে মাঠের বাইরে থেকেও অনেক সময় পরামর্শ দিই।
প্রশ্ন: আপনার আদর্শ কে?
চাহাল: শেন ওয়ার্ন। ছোট থেকে ওর বোলিংয়ের ভক্ত। এখনও সময় পেলেই ওয়ার্নের পুরনো খেলার ভিডিও দেখি।
প্রশ্ন: কখনও দেখা হয়েছে কিংবদন্তি ওয়ার্নের সঙ্গে?
চাহাল: ২০১১ সালে একবার দেখা হয়েছিল। তবে বোলিং নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়নি। দেখি সুযোগ কবে আসে।
প্রশ্ন: সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজেকে চিনিয়েছেন। পরবর্তী লক্ষ্য কী?
চাহাল: অবশ্যই টেস্টে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা। যে কোনও ক্রিকেটারেরই সেটা স্বপ্ন থাকে। গত বছরও খুব গুরুত্ব দিয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলেছিলাম। টেস্টে সুযোগ পেলে ভাল পারফর্ম করবই। সেই আত্মবিশ্বাস রয়েছে। নিজের দক্ষতায় আস্থা রেখেই এতদূর পৌঁছতে পেরেছি।
প্রশ্ন: ১৬ মাস আগে জিম্বাবোয়ের মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এখন ভারতের ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি দলের অন্যতম সেরা স্পিনার। জীবন কতটা বদলেছে?
চাহাল: অনেকটাই। এখন মাঠে আগের চেয়েও বেশি দায়িত্ব অনুভব করি। সাফল্য পেলে বাড়তি দায়িত্বও আসবে। সেটা পালন করার জন্য তৈরি করছি নিজেকে। ছুটির দিনেও তাই পরিশ্রম করছি। মাঠে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে পছন্দ করি। জানি, কখনও সাফল্য আসবে, কখনও আসবে না। সেটা একেবারেই আমার হাতে নেই। যেটা আমার হাতে রয়েছে, সেটা হল প্রস্তুতিটা সঠিকভাবে নেওয়া। সেটাই করে যাচ্ছি। সফল হওয়ার ব্যাপারে আমি আত্মবিশ্বাসী।