‘‘লেটস সেলিব্রেট লাইক বেঙ্গলি ওয়ে...।’’ রিয়েল কাশ্মীর দলের রিংটোন আপাতত এটাই। অন্তত রবিবারের রাতের জন্য হলেও। প্রথমে তারকাখচিত ইস্টবেঙ্গলকে যুবভারতীতে রুখে দেওয়া। আর এবার রবিবাসরীয় দুপুরে মোহনবাগানকে তছনছ করা। রিয়েল কাশ্মীর কলকাতা থেকে ফিরছে প্রাপ্তির ঘড়া পূর্ণ করে। দিনে মোহনবাগানকে ধস নামানোর পরেই রাতের প্ল্যানিং ঠিক করে ফেললেন কোচ ডেভিড রবার্টসন। বাঙালিদের স্পেশ্যাল মাছ আর মিষ্টিতেই জোড়া সাফল্য উদযাপন করা হবে।
যুবভারতীয় কাছেই এক হোটেলে রয়েছে রিয়াল কাশ্মীর দল। দেশ থেকে একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তা ঢুকছে কাশ্মীরের চাণক্যের মোবাইলে। তারই মধ্যে সময় করে স্কটিশ কোচ ডেভিড রবার্টসন এবেলা.ইন-কে জানালেন, ‘‘রাতেই মালিকদের সঙ্গে ডিনার পার্টি রয়েছে। সেখানে বাঙালিদের ফেভারিট মাছ চেখে দেখব আমরা সবাই। আর হ্যাঁ, মিষ্টিও থাকছে।’’ পুত্র ম্যাসনকে ট্রিটও দেবেন তিনি। ‘স্পেশ্যাল ফিস’ বলতে ‘হিলসা’ আর ‘সুইটস’ যে রসগোল্লা তার রহস্যভেদ হয় অবশ্য একটু পরেই!
হোটেলে ডেভিড রবার্টসন। — নিজস্ব চিত্র
সামান্য একটা পরিবর্তন। তাতেই রবিবারে কেঁপে গেল শঙ্করলাল ব্রিগেড। স্ট্রাইকার ক্রিজো-র চোট। বেশ কিছুদিন খেলতে পারবেন না। তাই পুত্র-স্টপার ম্যাসন রবার্টসনকে কোচ নামিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিজোর জায়গায়, ঘানাইয়ান ফরোয়ার্ড টেটেহ-র সঙ্গী করে। মিডফিল্ডার অ্যারন কেটাবে-কে লভডে-র সঙ্গে স্টপারে খেলিয়ে দেওয়ার ব্লু-প্রিন্টও তাঁর। ৬ ফুট ২ ইঞ্চির ম্যাসনই শেষ পর্যন্ত গেমচেঞ্জার। ওমর, সৌরভ, ইউটার উপরে প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল বাঁ-প্রান্ত থেকে আক্রমণে ওঠা সনি নর্দেকে বলের জোগান দেওয়া। ম্যাসন ঘেঁটে দিলেন। এরিয়াল বলে ৬ ফুট ২ ইঞ্চির স্কটিশ তারকা ওমর, সৌরভ, ইউটা-কে নিজেদের মধ্যে পাস খেলতেই দিচ্ছিলেন না। সাপ্লাই লাইন কেটে যাওয়াতেই সনি নিষ্প্রভ। বাগানের মাঝমাঠ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি জোড়া গোল এল তাঁর পা থেকে।
গোলের পরে সতীর্থের চুম্বন ম্যাসনকে। — আইলিগ
ম্যাচের আগে কোচ রবার্টসন কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন, ‘‘সনি বড্ড ওভাররেটেড ফুটবলার। ওঁকে নিয়ে অত মাতামাতি করার কী রয়েছে।’’ সনি বনাম রবার্টসন দ্বৈরথে জয়ী পাহাড়ি কোচই। কলকাতার ‘ফুটবল সম্রাট’কে এদিন ‘নিঃসঙ্গ’ বানিয়ে ছাড়ল কোচ রবার্টসনের মারণ-স্ট্র্যাটেজি। একে ওমর, ইউটাদের থেকে বলের সাপ্লাই নেই, সেই সঙ্গে সনির পায়ে বল গেলেই জোনাল মার্কিংয়ে চলে আসছিলেন একে একে রাভানন, লভডে, কেটাবেরা। সব মিলিয়ে হাসফাস করতে থাকা হাইতিয়ান ম্যাজিশিয়ান সেরা ছন্দ খুঁজে গেলেন গোটা ম্যাচেই।
বোতলবন্দি হয়ে পড়ছেন বুঝতে পেরেই দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা নীচ থেকে অপারেট করছিলেন হাইতিয়ান তারকা। সেটপিস থেকে দুর্ধর্ষ গোলও করে গেলেন। তবে সনির ফুলকি কোথায়! প্রত্যাবর্তনের সনিকে নির্বিষ করা আর ম্যাসন-ধাঁধা শঙ্করলালের সামনে রাখা— জোড়া রণকৌশলেই কলকাতা জয় ফার্গুসনের প্রাক্তন ছাত্রের।
সাংবাদিক সম্মেলনে কখনও লেটার মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া পুত্রের গর্বিত পিতা। কখনও আবার পেশাদারি কোচ! রবিবারের মহারণ আসলে ডেভিড রবার্টসনেরও পরীক্ষা নিল। তৃপ্ত গলায় সাংবাদিক সম্মেলনে বছর পঞ্চাশের কোচ বলছিলেন, ‘‘ম্যাসন পুত্র বলেই অনেক চাপ ছিল আমার উপরে। খারাপ পারফরম্যান্স করলেই কথা শুনতে হত। তবে ম্যাসন দেখিয়ে দিল ফুটবলার হিসেবে পারফর্ম করেই দলে সুযোগ পেয়েছে ও।’’
ডেভিড রবার্টসন ও তাঁর দুই পুত্র। — এএফপি
পিতার কোচিংয়ে ম্যাসন আগেও খেলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিনিক্স রাইজিংয়ে। স্কটল্যান্ডে প্রথম ডিভিশনের স্টেনহাউসমুইর, পিটারহেড এফসি-তে খেলে কলকাতায় এসেছেন। তবে স্কটল্যান্ডে তারকা-খ্যাতি ছিল না। শহর কলকাতা দিয়ে দিল তারকার ট্যাগলাইন। তা-ও এক মহাতারকার নিষ্প্রভ থাকার দিনে।
দুই কোচের ভাগ্যও ঠিক করে দিলেন ফুটবল-ঈশ্বর। কয়েকদিন আগেও দীর্ঘ আট বছরের খরা কাটিয়েছিলেন কলকাতা লিগে। সমর্থকদের বরমাল্য পাওয়া শঙ্করলালের আইলিগের মাঝপথেই প্রস্থান, কাশ্মীরের সঙ্গে হেরে। অন্যদিকে, বিদেশ-বিভুঁইয়ের অচেনা পরিস্থিতিতে কোচিং করানোর মান্যতা পেলেন রবার্টসন। যুুবভারতীর সম্রাট হয়েই শহর ছাড়ছেন তিনি। বছরের প্রথম রবিবার আসলে নির্ণায়ক হয়ে থাকল দুই কোচের কেরিয়ারের দিক-বদলে!