বাকি পৃথিবীর মতো বাঙালির চায়ের টেবিলে বার বার উঠে আসছে মেসি, রোনাল্ডো, নেমারদের নাম। কেউ ব্রাজিল, কেউ আর্জেন্টিনা, কেউ বা জার্মানি, পর্তুগাল। এরই পাশাপাশি আলোচনায় উঠে আসছে আয়োজক দেশ রাশিয়ার নামও। দেশটা নিয়ে বাঙালির আগ্রহ তো আজকের নয়। বিপ্লবের আঁতুড়ঘর রাশিয়ার নামে চিরকালের রোমাঞ্চ বাঙালির। সেই দেশেই এবারের বিশ্বকাপ। তাই ফুটবল আর বিপ্লবের যুগলবন্দি বাঙালির মনের কোণে।
মনে পড়ে যাচ্ছে এক কিংবদন্তিকেও। তিনি লেভ ইয়াসিন। রাশিয়ার সর্বকালের সেরা ফুটবলার। স্ট্রাইকার নন তিনি। ডিফেন্স বা মাঝমাঠও নন। তিনি গোলকিপার। গোলের সামনে দাঁড়িয়ে ৬ ফুট ২ ইঞ্চির দীর্ঘদেহে তিনি জয় করেছেন বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত রাশিয়ার বুক থেকে উঠে আসা কিংবদন্তি লেভ ইয়াসিনের বড় হয়ে ওঠা এক আশ্চর্য রূপকথা। সেও এক বিপ্লবই। তিনিই তো এই বিশ্বকাপের পোস্টারে রাশিয়ার মুখ। তাঁকে দেখা যাচ্ছে সেভ করার ভঙ্গিতে। হাতের তালুতে লেগে একটা চামড়ার বল। বল নাকি পৃথিবী? আসলে অর্ধেকটা বল অর্ধেকটা পৃথিবীর অবয়ব। গোটা ফুটবল-পৃথিবী আর একবার স্মরণ করছে এক লড়াকু জীবনকে।
বিশ্বকাপের অফিশিয়াল পোস্টারে লেভ ইয়াসিন। ছবি: ফিফার ওয়েবসাইট।
আশ্চর্য এক জীবন। ১৯৬৩ সালে পেয়েছিলেন ‘ব্যালন ডি’অর’। এই নীল গ্রহের একমাত্র গোলকিপার, যিনি এই সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর জীবন মোটেই রত্নখচিত ছিল না। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই লড়াই। নাৎসি আক্রমণের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালানো। কেবল বাড়ি নয়, নিজের ছেলেবেলাকেই যেন ফেলে এলেন দূরে।
এগারো বছর বয়সেই শেষ হয়ে গেল ছোটবেলা। ১৯৪১ সালের শরৎকাল। যুদ্ধের অতিকায় দানব কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে সভ্যতাকে। পরিবারের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো থেকে পালালেন ছোট্ট ইয়াসিন। সে বড় সুখের সময় নয়। নাৎসি বাহিনী তখন মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লেনিনগ্রাদ ঘিরে ফেলেছে হিটলারের বাহিনী। ভয়ঙ্কর এক সময়। পরবর্তী বছর দুয়েকের মধ্যে মারা যাবেন সাড়ে সাত লক্ষ সাধারণ মানুষ। খাবার না পেয়ে গরম জলের মধ্যে চামড়ার বেল্ট ফুটিয়ে খেতে হচ্ছে! আরও কত কুখাদ্য। বেঁচে থাকা বড় বালাই। প্রয়োজনে ইঁদুর ধরেও মেরে খেতে আপত্তি নেই মানুষের।
ইয়াসিনরা এসে পৌঁছলেন উলিয়ানোভস্কে। মস্কো থেকে ৮০০ কিমি দূরের সেই শহরেই আপাতত থাকবেন তাঁরা। সংসার চালাতে বুলেট তৈরির কারখানায় কাজ করতে শুরু করলেন ইয়াসিন। সে এক তীব্র কঠিন জীবন। দু’টুকরো রুটির জন্যও লাইনে দাঁড়াতে হবে। আর স্বপ্ন দেখা, কবে শেষ হবে সেই দিন। তাঁরই হাতে তৈরি বুলেট ব্যবহৃত হচ্ছে যুদ্ধে। নিজের আঙুল, যা পরবর্তী জীবনে বল আটকানোর কাজে লাগবে, তা সেই সময় স্পর্শ করছে যুদ্ধের উত্তাপময় ধাতু।
তাঁকে ডাকা হতো ‘কালো মাকড়সা’ বা ‘কালো চিতা’ বলে। ছবি: উইকিপিডিয়া।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ১৯৪৪। এই বছর তিনেকের অভিজ্ঞতা ইয়াসিনের সারা জীবনের সঞ্চয়। বুঝতে পেরে গেলেন কত অনিশ্চিত এই জীবন। শেষ পর্যন্ত হিটলার পরাস্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু লাল বাহিনীর গৌরবময় জয়ের পরেও লড়াই বাকি রয়ে গিয়েছিল। বেঁচে থাকার লড়াই। সংগ্রামের সেই দিন ভিতরে ভিতরে ইয়াসিনকে আরও পোক্ত করে তুলেছিল।
আসলে গোলকিপারের কাজটা অসীম ধৈর্য ও সাহসের। কখন একটা বল আসবে, তার জন্য ক্লান্ত হলে চলবে না। সতেজ অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর বলটা এলে দিতে হবে চূড়ান্ত রিফ্লেক্সের পরীক্ষা। এই যে ব্যালান্স, সেটা ইয়াসিন শিখে নিয়েছিলেন সেই বয়সেই।
শেষ বয়সে বুদাপেস্টে অসুস্থ ইয়াসিনের একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। যে মানুষটা এক লাফে শূন্যে উঠে যেত, সেই ‘কালো মাকড়সা’ লেভ ইয়াসিনের শেষ জীবন ছিল আর এক অনন্ত ধৈর্য ও লড়াইয়ের অধ্যায়। তার পরেও চার বছর বেঁচেছিলেন তিনি। যকৃতের ক্যানসারে শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হয়। কিন্তু বালক বয়স থেকে শুরু করে ইয়াসিনের সেই আজীবনের লড়াই এক উদ্দীপনার কীর্তিময় কাহিনি হয়ে রয়ে গিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে।
তাঁকে সম্মান জানিয়ে মস্কোর ডায়নামো স্টেডিয়ামে তৈরি করা হয়েছে তাঁর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। রাশিয়ার সর্বোচ্চ খেতাব ‘অর্ডার অফ লেনন’ পেয়েছেন তিনি। নির্বাচিত হয়েছেন শতাব্দীর সেরা গোলকিপার। কেবল ফুটবল নয়, তরুণ বয়সে আইস হকিতেও দুরন্ত পারফরম্যান্সে দলকে জিতিয়েছিলেন সোভিয়েত কাপ। সেখানেও তিনি গোলকিপার। লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স।
ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটিতে ফুটে উঠেছে ইয়াসিনের অনমনীয় পুরুষকার। ছবি: উইকিপিডিয়া।
সারা জীবনই এই লড়াই করে যেতে হয়েছে তাঁকে। যে লড়াই তাঁকে দিয়েছে বিশ্বসেরার তকমা। কিন্তু কিংবদন্তি মানুষটার জীবনের দুর্মর সংগ্রামের খোঁজ ক’জন জানেন! মঞ্চটাই তো সব নয়। গ্রিনরুমটা ক’জন দেখেন। আর একজন গোলকিপারের জীবনে তো মঞ্চ আর গ্রিনরুম মিলেমিশে থাকে। অপেক্ষার গ্রিনরুমই আচমকা হয়ে ওঠে মঞ্চ। আলোকবৃত্ত এসে পড়ে মুখের উপরে।
পেয়েছেন শতাব্দীর সেরা গোলকিপারের তকমা। ছবি: উইকিপিডিয়া।
ইয়াসিন জানতেন সেই চাপ কীভাবে সামলাতে হয়। তাই তো তিনি জিনিয়াস। স্নায়ুর যুদ্ধে টানটান জয় চিরকালই তাঁদের মতো মানুষদের জন্য বরাদ্দ থাকে। সেটা মাঠে হোক বা জীবনের অন্য কোণে— আজীবন অপরাজিত থেকেছেন লেভ ইয়াসিন। অনন্ত প্রহরায় বাঁচিয়ে রেখেছেন জীবনের লড়াকু আগুন।