‘যখন অরণ্য পুড়ে যাচ্ছে তখন গোলাপের জন্য কান্না কেন?’
কবির এ হেন পংক্তি বাংলার খেলাতেও কতখানি সত্যি তা টের পাওয়া গেল বেলগাছিয়ার এক সরকারি আবাসনে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বাংলার ছাত্র মাল্যবান আসের মুখোমুখি হয়ে।
আগ্রাসী প্রযুক্তির সৌজন্যে আজ ইপিএল, লা লিগা এমনকি দুবাই ওপেন নিয়েও মাদকতা। আজকের কচি-কাঁচারা জানেই না, ‘সাত ঘুঁটি’ কী, ‘হিঙে’ কীভাবে খেলতে হয়, ‘বুড়িবসন্ত’ গায়ে মাখে না মাথায় দেয়।
অথচ যখন উপনিবেশবাদের পদার্পণ ঘটেনি, তখন বাংলার মাঠ-ময়দান ডাংগুলির হুঙ্কারেই উচ্চকিত হতো।
বছর উনিশের মাল্যবান আদপে ধনেখালির যদুপুরের ছেলে। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বাবা কবি-সম্পাদক অরূপ আস সুপরিচিত নাম। মা অর্পিতা লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশক। গান-বাজনার পরিমণ্ডলে লালিত মাল্যবান। নিজেও গান করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। গানের জন্য সরকারের বৃত্তিও পায়। কলকাতায় পড়াশুনো। কিন্তু ছেলেবেলা থেকে মাঝেমধ্যেই গ্রামের বাড়ি ছুটিছাটায় গেলে, তার মনে হতো আর কতদিন ছেলেছোকরারা গর্তে গুলি ফেলার আনন্দে মেতে থাকবে। বাবা প্রায়ই ওকে বলতেন, ‘‘জানিস এসব খেলার কোনও চিহ্নই আর থাকবে না। কারণ ডকুমেন্টশন করে রাখার সদিচ্ছাই কারও নেই।’’
‘‘বাবার কথাটাই মাথায় ঘুরত। এক সময় গান, সাহিত্যর পাশাপাশি পড়লাম সিনেমারও প্রেমে। তবে তথ্যচিত্র নিয়েই উৎসাহটা বেশি ছিল। প্রাথমিক পাঠ নিলাম রাজ্য সরকারের ফিল্ম-মেকিং ওয়ার্কশপে। আমার প্রথম তথ্যচিত্র মূক-বধিরদের নিয়ে। ছোট্ট কাজ। তবে কলকাতার শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছিল। তারপর তাঁতশিল্পীদের নিয়েও ছবি করেছি,’’ বলছিল মাল্যবান। জীবনানন্দ দাশের জন্মতারিখে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল বলে, তাঁর উপন্যাসের প্রেরণায় বাবা-মা ছেলের এমন নাম রেখেছেন। এবং বয়সের তুলনায় সে কী না যথেষ্ট গম্ভীর।
বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলা আজ আক্ষরিকই নিরুদ্দিষ্ট। কোথায় তার ইতিহাস? বিশিষ্ট সাংবাদিক চিরঞ্জীব একাধিক বই লিখেছিলেন অনেক বছর আগে। কিন্তু বইবাজারে তার এক কপিরও হদিশ কেউ দিতে পারে না। আরও আক্ষেপের, বাংলা সাহিত্যেও তার চিহ্ন বিশেষ নেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে মানিকবাবু বা আরও অনেকের কালজয়ী কত না কাজ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে। কিন্তু বাঙালির দূভার্গ্য, তাতে হারিয়ে যাওয়া খেলার বর্ণনা দূরের কথা, উল্লেখও প্রায় নেই। হাল আমলের দুলেন্দ্র ভৌমিকের গল্প ‘গুলিখেলা’ আর কিন্নর রায়ের ‘ওপেন টি বায়োস্কোপের…’ মতো প্রায় বিলুপ্ত খেলা নিয়ে প্রবন্ধে সেসবের অবস্থান নেহাতই যেন দুর্ঘটনা! ক’জনই বা জানেন লোকক্রীড়া গবেষক দীপঙ্কর ঘোষের কাজের কথা!
তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে বহু বিশিষ্ট মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে মাল্যবান। কথাসাহিত্যিক শীর্যেন্দু মুখোপাধ্যায়ও হারিয়ে যাওয়া খেলা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের দীনতার কথাই বলেছেন ওকে। আক্ষেপও করেছেন। এবং আরও একধাপ এগিয়ে মাল্যবানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘শুধু তো বাংলা সাহিত্য নয়। সিনেমার কথাও ধরুন। পথের পাঁচালি যেমন। অমন নিঃসঙ্গ অপু কী খেলাধুলো করত না? করলে তো এইসব প্রাচীন-গ্রামীন খেলাই খেলত! কিন্তু সেখানেও নেই।’’
বয়স কম হলেও যথেষ্ট পরিণত মাল্যবান। ওর ইচ্ছে, স্নাতক হয়ে (নাকি তার আগেই?) পুণেতে সিনেমা নিয়ে পড়াশুনো করার। এই বয়সেই তথ্যচিত্র বানিয়ে পুরস্কৃত এমন এক প্রতিশ্রুতিমান স্বপ্ন দেখতেই পারে। এবং যখন নাগাড়ে বলে যায়, সাত ঘুঁটির নাড়িনক্ষত্র। বুড়ি বসন্তে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ছায়া। গুলি খেলায় গাই-বাছুরের ভূমিকা। ডাংগুলিতে পেয়ারা কাঠের মাহাত্ম্য। ‘গ্রামীণ দাবা’ বাঘবন্দির নেশা। গাছগাছালির অন্দরে রুমালচোরদের হুটোপুটি-লোকগাথা— তখন সত্যিই চমকে যেতে হয়।
গুড়াপ থেকে বড়শুল। দামোদরের চর হয়ে দে’দের জমিদারবাড়ি। বাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলার দস্তাবেজের খোঁজে ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে কোথায় যায়নি মাল্যবান।
ওইটুকু ছেলে, ভিডিও গেমস এবং মেসি-রোনাল্ডোর জমানার প্রতিনিধি হয়েও এমন প্রত্যন্ত বিষয়ের প্রতি আকুলতা, যে কোনও সচেতন বাঙালিকে আচ্ছন্ন করতে বাধ্য।
এবং সেসব শুনতে শুনতে মনে হয়, রাত জেগে ক্রিকেটের ‘সার্কাস’ দেখতে দেখতে অবসন্ন আমরা, কবে দেখব চু কিত কিতের মাদকতা? প্রত্যয়ী এই কিশোর জানায়, ‘‘আরও দু’তিন মাসে লাগবে। ইচ্ছে দেশি-বিদেশি ফেস্টিভ্যালে পাঠানো। আসলে এই ধনের কাজে তো পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যায় না। বাবাই ছবির প্রযোজক। তাই সময় একটু গড়াচ্ছে। কী আর করব!’’তা ‘খেলা যখন’ সম্পূর্ণ হতে লাগুক সময়। আর একটু অপেক্ষাই না হয় করি। গাঁ-গঞ্জে গিয়েও তো সেই সাতটা ঘুঁটি সাজিয়ে বানানো নকল পাহাড়কে প্লাস্টিকের বল দিয়ে ভেঙে ‘দে ছুটের’ উন্মাদনা দেখতে পাব না।