— ‘‘১৯৯২ সালে বাবার পাওয়া সমস্ত পদক, পদ্মশ্রী মেডেল, দুষ্প্রাপ্য ১৩টি ছবি তুলে দিয়ে এসেছিলাম মোহনবাগানের হাতে। সেই সব ট্রফি, ছবি কোথায় গেল?’’
— ‘‘আমাদের পদবি পালচৌধুরী। ইংরেজদের কাছ থেকে চৌধুরী পদবি পেয়েছিলাম। তখন দেশে ইংরেজ শাসন। বাবা ইংরেজদের দেওয়া চৌধুরী টাইটেল কোনওদিন ব্যবহারই করেননি। আমার কাকারা পালচৌধুরী টাইটেল ব্যবহার করলেও আমরা তা ব্যবহার করি না। আমরা পদবি হিসেবে লিখি পাল।’’
— ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন রেলমন্ত্রী। একটা মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করা হোক বাবার নামে। এই অনুরোধ করেছিলাম মমতার কাছে।টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন উত্তম কুমারের নামে। বাবার নামে নেই কোনও মেট্রো স্টেশন।’’
তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে গোষ্ঠ পাল। ছবি— গোষ্ঠ পালের ফেসবুক পেজ থেকে
গলায় অভিমানের বাষ্প জড়িয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন গোষ্ঠ পালের পুত্র নীরাংশু পাল। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কি মনে হচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছেন কিংবদন্তি ফুটবলার? মোহনবাগানের শিল্ড জয় নিয়ে সিনেমা হয়েছে অতীতে। রহিম সাহেবকে নিয়ে ছবি তৈরি হতে চলেছে। শিবদাস ভাদু়ড়ির ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ভাবছেন জন আব্রাহাম। আর তিনি, গোষ্ঠ পালকে নিয়ে রূপোলি পর্দা কাঁপানোর কথা ভাবছেন না কেউ? অথচ তাঁর জীবনে তো রয়েছে অনেক গল্প। রয়েছে সিনেমা হওয়ার রসদ। তবুও গোষ্ঠ পালকে নিয়ে হচ্ছে না বায়োপিক। বিস্মিত ৭৯ বছরের নীরাংশুবাবু।
গোষ্ঠ পালের নামে ডাকটিকিট।
গোষ্ঠ পালকে নিয়ে কলকাতা ময়দানে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। একটি ম্যাচে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ভুল পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন রেফারি। প্রতিবাদে মাঠের ভিতরে শুয়ে পড়েছিলেন গোষ্ঠবাবু। তাঁর দেখাদেখি বাকিরাও মাঠে শুয়ে রেফারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। গোষ্ঠ পালের এহেন প্রতিবাদে খুশি হয়নি আইএফএ। তাঁকে সাসপেন্ড করতে চেয়েছিল ফুটবল সংস্থা। সেই খবর গোষ্ঠবাবুর কানে পৌঁছতেই তিনি ফুটবল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।
১৯৬২ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় গোষ্ঠ পালকে। ভারতের প্রথম ফুটবলার হিসেবে তিনি এই নজির গড়েন। ধুতি-পঞ্জাবি পরেই রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের হাত থেকে সম্মান গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই পদ্মশ্রী সম্মান, সারা জীবনে পাওয়া অসংখ্য ট্রফি, পুরস্কার— এখন আর নেই গোষ্ঠ পালের ছেলে নীরাংশুবাবুর কাছে। এবেলা.ইন-কে তিনি বলছিলেন, ‘‘বাবা চলে গিয়েছেন ১৯৭৬ সালে। ১৯৯২ সালে বাবার ইচ্ছানুয়ায়ী সমস্ত পুরস্কার, ট্রফি, দিয়ে এসেছিলাম মোহনবাগানের হাতে। আসলে বাবা চাইতেন, প্রাক্তন ফুটবলারদের পাওয়া পুরস্কারগুলো ক্লাবের প্রদর্শনশালায় জায়গা পাক। সেগুলো দেখতেই সমর্থকরা আসবেন। তাতে অর্থাগম হবে ক্লাবেরই। বিশ্বের সমস্ত ক্লাবেই রয়েছে এমন ব্যবস্থা। কিন্তু সেই সব ট্রফিগুলো এখন কোথায় রয়েছে, তার সন্ধান আমার জানা নেই। মনোকষ্টেও ভুগছি।’’
গোষ্ঠ পালের পুত্রকে আশ্বস্ত করে মোহনবাগানের সহ সচিব সৃঞ্জয় বসু বলছেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা নতুন সেট আপ করব। সেখানেই ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলারদের পাওয়া পুরস্কার শোভা পাবে। থাকবে মোহনবাগানের জেতা ট্রফিও। আমরা যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে সেগুলো প্রদর্শন করব।’’
১৯১৩ সালে মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন ‘চাইনিজ ওয়াল’। দেশের অধিনায়ক হিসেবে সিংহলে গিয়েছিলেন তিনি। গোষ্ঠ পাল যেন ইতিহাসের এক শিহরণের নাম। মোহনবাগান অন্ত প্রাণ ছিলেন তিনি। শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবে চুটিয়ে খেলার সময়েই ইস্টবেঙ্গলে খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। টাকার অঙ্ক ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। তখনকার সময়ে এক লক্ষ টাকা ও পার্ক স্ট্রিটে একটি বাড়ি দেওয়া হবে— এমন লোভনীয় প্রস্তাবেও টলানো যায়নি ‘চাইনিজ ওয়াল’কে।
নীরাংশু পাল। গোষ্ঠ পালের পুত্র।
কথায় বলে, সেই ধন্য নরকুলে, লোকে যারে নাহি ভুলে। গোষ্ঠ পালও তো সেরকমই এক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে তো ভোলার কথাই নয়। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নীরাংশুবাবুর উপলব্ধি, গোষ্ঠ পালের কথা এখন অনেকেই জানেন না। ‘‘অশোকনগরে বাবার অ্যাকাডেমিতে এক ফুটবল-শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, গোষ্ঠ পালের নাম শুনেছ? সেই ছেলেটি জবাব দিতে পারেনি। বাবার স্মৃতি জীবন্ত রাখতে হলে যা করার দরকার ছিল, তা তো আর হয়নি।’’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন গোষ্ঠ পালের পুত্র। মোহনবাগান মেম্বার গ্যালারির নাম গোষ্ঠবাবুর নামে। ময়দানে রয়েছে গোষ্ঠ পালের মূর্তি। শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাব তাঁকে মরণোত্তর ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মানে ভূষিত করেছে। তবুও কি কিংবদন্তি ফুটবলার যোগ্য সম্মান পেলেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরাংশুবাবু বলছিলেন, ‘‘ক্রীড়াবিদের নামে যদি স্টেডিয়াম হতো, তাহলে সেই খেলোয়াড়ের নাম ছড়িয়ে পড়তো।বাবার সম্পর্কে এআইএফএফ বইয়ে শুধু লিখেছে গোষ্ঠ পাল পদ্মশ্রী পেয়েছেন। এর বেশি একটা লাইনও নয়। লেখার মাধ্যমে বাবার স্মৃতি জীবন্ত রাখা যেত। বাবাকে নিয়ে মনে হয় এখন আর কেউ লেখার উৎসাহও পাচ্ছেন না।’’
তবে কি ধীরে ধীরে স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবেন গোষ্ঠ পাল? মনে ঝড় নীরাংশুবাবুর।