২০০৬ সালের নভেম্বর মাস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়িতে সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছেন। হঠাৎই মমতা টালির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন সিঙ্গুরে যাবেন বলে। জমি আন্দোলনে উত্তপ্ত সিঙ্গুরে তখন ১৪৪ ধারা। সারি সারি গাড়ির বিশাল কনভয় নিয়ে জাতীয় সড়ক ধরে চলেছেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী। কিন্তু ডানকুনিই পেরোতে পারলেন না তিনি। হুগলি জেলাতে ঢোকার মুখে মাইতিপাড়াতেই পুলিশ আটকে দিল তাঁকে। সেখানেই পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি।
বাম সরকারের জমানায় এমন চিত্র বহুবার দেখা গিয়েছে। বিশেষত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। মমতাকেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয়েছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের সঙ্গে।
তা সে জ্যোতি বসুর সরকারই হোক বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার, মমতার মুখে রাজ্যে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ বা রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছিল।
গত কয়েকদিন ধরে বিজেপি নেতাদের দেখে মনে হচ্ছে যেন, মমতার ‘লেখা বই’ পড়েই এগিয়ে চলেছেন তাঁরা।
বসিরহাট নিয়ে কলকাতায় বিজেপির মিছিল
বসিরহাটের সংঘর্ষ-বিধ্বস্ত এলাকায় যেতে গিয়ে পুলিশের কাছে বাধা পেয়ে কলকাতায় ফিরে আসতে হয়েছে বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতাদের। শেষে কলকাতার রাজপথে, বসিরহাটের ঘটনার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করে মিছিল করতে হয়েছে দিলীপ ঘোষদের। মিছিল শেষে ছুটতে হয়েছে রাজভবনে। সেই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবি নিয়েই।
কলকাতা হাইকোর্ট পরিষ্কার বলেছে রাজ্য সরকার সিঙ্গুরে ১৪৪ ধারা জারি করে ভুল করেছে। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার হয় পেশির আস্ফালন করছে, নয় বিরোধীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। ৩৫৬ ধারা জারির জন্য পশ্চিমবঙ্গ একদম ঠিক কেস।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৩ মার্চ, ২০০৭
সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য মমতাও তো জেলার ঘটনাকে বার বার কলকাতায় এনে ফেলেছেন। তা সে সিঙ্গুরের জন্য ধর্মতলায় অনশন হোক বা নন্দীগ্রামের জন্য মিছিল অথবা সিপিআইএম-এর সঙ্গে সংঘর্ষে তৃণমূল কর্মীর দেহ নিয়ে মিছিল। সেদিনের বিরোধী নেত্রী বার বার দ্বারস্থ হয়েছেন রাজভবনের।
তখন যেমন নন্দীগ্রাম নিয়ে রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর ‘হাড় হিম’ করা মন্তব্য রাগিয়ে দিয়েছিল বাম-নেতৃত্বকে, এখনও রাজ্যপালের ফোন নিয়েই বিরক্ত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমরা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সরকারিভাবে বলব রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করার কথা।দিলীপ ঘোষ (বসিরহাটের ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনে), ৭ জুলাই, ২০১৭
তবে ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত যেমন জমি আন্দোলন নিয়ে উত্তপ্ত ছিল রাজ্য, এখন রাজ্য উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিয়ে। জমি ও মানুষের অধিকারের রাজনীতিকে হাতিয়ার করেই মমতা এগিয়েছিলেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়ের পরে এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বসিরহাট নিয়ে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য
মানুষের অধিকারের থেকে মানুষের পরিচয়ের রাজনীতি বড় হয়ে উঠেছে। এসেছে কালিয়াচক, হাজিনগর, ধুলাগড়, বাদুড়িয়া। একেই হাতিয়ার করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
মমতাকে সংখ্যালঘু তোষণের জন্য অভিযুক্ত করে মাঠে নেমেছেন বিজেপি নেতারা। তবে মমতার মতো এখনও মাটি কামড়ে থাকছেন না গেরুয়া শিবিরের নেতারা। রূপা-লকেটরা চেষ্টা করেছেন বটে, তবে সঙ্ঘ পরিবার বা সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ সংগঠনগুলির সাহায্যেই স্থানীয় শক্তিকে সংগঠিত করতে চাইছেন বিজেপি নেতারা। ভরসা রাখছেন মেরুকরণ ও নরেন্দ্র মোদীর ক্যারিশমার উপর। দুর্নীতির তদন্তে উত্যক্ত করে তুলছেন মমতা-শিবিরকে।
অধিকারের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে পরিচয়ের রাজনীতি বাংলাকে কোন খাতে নিয়ে গিয়ে ফেলে নজর এখন সেই দিকেই।