ইতিহাস থেকে প্রক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা তুলে, তা সংকীর্ণ রাজনীতির যুক্তিশৃঙ্খলে সাজানো শুধু ভুল নয়, অন্যায়ও। অথচ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির কারবারিরা ঠিক সেই কাজটিই করে চলেছেন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ঠিক সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছে বিজেপি। দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যার ইতিহাসটিকে মনে করিয়ে দিয়ে তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করছে। মানুষের আবেগকে সংকীর্ণ রাজনীতির চালচিত্রে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। এবং সে কাজটি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়া হচ্ছে না। রবীন্দ্ররচনার প্রক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, কবিও হিন্দুত্ববাদ এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে সমর্থন করেছিলেন।
রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে যাঁরা সামান্যতমও পরিচিত, তাঁরা জানেন, কবি বরাবর ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রচারক ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কখনওই তিনি সমর্থন করেননি। বস্তুত, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর্বেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাটি খুব স্পষ্টভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এবং সময়ে সময়ে মূলস্রোতের রাজনীতির সংকীর্ণ মূল্যবোধের সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। রাখিবন্ধনের মতো পরিকল্পনা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। সুতরাং, তাঁর রচনা থেকে একটি বা দু’টি অনুচ্ছেদ তুলে নিয়ে যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না।
জাতীয়তাবাদের প্রচারে বিজেপি আসলে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করছে। হিন্দুত্ববাদী অতি পণ্ডিতদের সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজ়ম’ সংক্রান্ত প্রবন্ধ পড়া নেই। ১৯১৬ সালে জাপান এবং আমেরিকায় উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তৃতাগুলির খবরও সম্ভবত তাঁদের কাছে নেই। থাকলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মঞ্চে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করার আগে তাঁরা দু’বার ভাবতেন। আসলে রবীন্দ্রনাথ নয়, কবিকে ঘিরে বাঙালির আবেগকে ব্যবহার করতে চাইছে বিজেপি। আর সে কারণেই, যেনতেনপ্রকারেণ তাদের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় দেশভাগ, রবীন্দ্রনাথ— এমন আরও অনেক কিছু ঢুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। দেশ জুড়ে ইতিহাস পুনর্লিখনের নামে সত্যের অপলাপ করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না।