চার বছরের এক ছাত্রীর উপরে স্কুলেরই দুই শিক্ষক যৌন নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠল। সেই অভিযোগকে ঘিরেই উত্তাল হয়ে উঠল জিডি বিড়লা স্কুল চত্বর। শিশুর প্রাথমিক জবানবন্দি ও বাবা-মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হলেন দু’জন শরীরশিক্ষার শিক্ষক।
অভিভাবকদের আন্দোলনে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ছুটিতে পাঠানো হল প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে। অভিযোগ দায়ের হলেও তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি।
ছাত্রীটির মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার পরে ধন্দ তৈরি হয়েছে সত্যিই কি কোনও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ছাত্রীটির সঙ্গে। সপ্তাহখানেক পরেও অভিযুক্ত শিক্ষকরা এখনও স্বীকার করেননি তাঁরা অপরাধ করেছেন বলে।
এ সব আইনি ও পুলিশি তদন্তের বিষয়। অপরাধ প্রমাণ তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু এই পুলিশি তদন্তের বাইরেও আসল ‘অপরাধী’-কে খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
সবাই দু’টি বিষয় খেয়াল করেছেন। এক, ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর জিডি বিড়লা স্কুল কর্তৃপক্ষের ‘আমরা দোষী নই’ বলে সাফাই গাওয়া। দুই, অভিভাবকদের রুদ্রমূর্তি।
বাবা-মায়েরা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। স্কুলের গাফলতি নিয়ে তাঁরা সরব হতেই পারেন। কিন্তু কতটা ক্ষোভ জমলে তাঁরা রাস্তায় নামতে পারেন, তা-ও অনুমেয়।
অন্য দিকে স্কুলের প্রতিক্রিয়াও বিস্ময়কর। অসুস্থ ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করার থেকেও প্রিন্সিপাল শর্মিলি নাথ ব্যস্ত ছিলেন এটা বলতে যে, তাঁরা সুস্থ অবস্থাতেই ছাত্রীটিকে অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছেন। কেউ কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি।
এখন প্রতিটি নামী স্কুলেই সিসি ক্যামেরা বসানো থাকে। তিন বছর আগে একই রকম যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পরেও কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা করতে পারেনি জিডি বিড়লা স্কুলে।
কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি হল যে, অভিভাবকদের বড় অংশ স্কুলের সঙ্গে এমন সংঘাতে যেতে বাধ্য হলেন? দেড় দু’দশক আগেও তো এমনটা দেখা যেত না সচরাচর!
আসলে শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবকদের মধ্যে বিশ্বাসের বাতাবরণটাই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। সেটি হয়েছে মূলত নামী বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার বাণিজ্যিকরণের মধ্যে দিয়ে।
কলকাতারই এক ‘ফাইভ-স্টার’ স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক সব্যসাচী মিত্র একটি ভাল ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে স্কুল একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতো ‘ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং’-এর জায়গা হয়ে গেছে।’’
‘ক্লায়েন্ট’ এখানে অভিভাবক আর ‘সার্ভিস প্রোভাইডার’ হল স্কুল। সব্যসাচীর কথায়, ‘‘তাও ছাত্র-ছাত্রীরা ‘ক্লায়েন্ট’ হলে একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু স্কুলগুলি অভিভাবকদের ‘ক্লায়েন্ট’ ভাবে। শিক্ষাও ‘পাবলিক গুড’ থেকে ‘প্রাইভেট গুড’ হয়ে গেছে।’’
শুনে নিন জিডি বিড়লা কাণ্ড নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য:—
অভিভাবকরাও ভাবেন, আমি টাকা দিচ্ছি, কাজেই আমায় ভাল পরিষেবা প্রাপ্য। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই আমি কাঠগড়ায় তুলব স্কুলকে। স্কুলও ভাবে, আমায় গা বাঁচিয়ে চলতে হবে। কোনও ফাঁক রাখা চলবে না। তাই প্রিন্সিপাল শর্মিলি নাথ ছাত্রীর খবর নেওয়ার আগে হাত ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেন কার্যত এই বলে যে, আমি ‘ক্লায়েন্ট’-কে হ্যান্ডওভার করে দিয়েছি, এবার তাঁর দায়িত্ব। আমাদের এখানে কোনও ‘ডিফেক্ট’ ছিল না। অভিভাবকদের উদ্দেশে চিঠি লিখে আক্রান্ত ছাত্রীর নাম প্রকাশ করতেও দ্বিধা বোধ করেননি।
আসলে এখন শিক্ষকদের থেকেও অভিভাবকদের গলার জোর অনেক বেশি (তাই তাঁদের আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে স্কুলকে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়)। শিক্ষক স্বাভাবিক কারণেই ‘শেষ কথা’ বলেন না। শুনতে সনাতন ভারতীয় তত্ত্বের মতো লাগলেও, এখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরনো দিনের ‘গুরু-শিষ্যে’র সম্পর্কে টান পড়েছে।
এর জন্য বিশ্বায়ন খানিকটা দায়ী তো বটেই। সমাজের ধরনটাই বদলে যাচ্ছে। সেখানে নিরাপত্তার জন্য সিআইএসএফ বা সিসিটিভিও লাগছে। শিশুদের সচেতন করতে হচ্ছে ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’-এর বিষয়ে।
আমরা পশ্চিমী দুনিয়ার কিছু আদব-কায়দা ধার করছি। কিন্তু পুরোটা গ্রহণ করছি না। বিদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮-১০ জন ছাত্র-ছাত্রী প্রতি একজন ‘পার্সোনাল টিউটর’ থাকেন (প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না)। তাঁর কাজই হল, পড়াশোনা-সহ ছাত্র-ছাত্রীর অন্যান্য সুবিধা অসুবিধায় অভিভাবকের কাজ করবেন তিনি। সঙ্গে কাউন্সেলিং সেন্টার, নাইট লাইফলাইন, লিঙ্গ সচেতনতার ওয়ার্কশপ— এই রকম অনেক ব্যবস্থা রয়েছে।
এই ঝামেলার মধ্যে আমার একজন প্রিয় শিক্ষক সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি কথা খুব ভাল লাগল। তিনি লিখেছেন, ‘‘এখানে ফেট আছে, ইউনিট টেস্ট আছে, সাম আপ টেস্ট আছে, মক টেস্ট আছে। দরজায় ভয় জাগানো সিকিউরিটি আছে। নেই শুধু বন্ডিং। আছে ব্যবসায়িক আদান-প্রদান, নেই কোন হৃদয়।’’
জিডি বিড়লা হোক বা এম পি বিড়লা কাণ্ডে কে আইনের চোখে অপরাধী, সেটা তো পরে দেখা যাবে। আপাতদৃষ্টিতে আসল অপরাধী কিন্তু অভিভাবক-ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসের ও আত্মিক যোগের অভাব।