নাট্যব্যক্তিত্ব গিরিশ কারনাডকে খুনের হুমকি দিয়েছে অসহিষ্ণু-উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। কারনাডের দোষ, তিনি টিপু সুলতানের ২৬৬তম জন্মদিবসে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তাণ্ডবের নিন্দা করেছেন। কারনাড বলেছিলেন, টিপু যদি মুসলিম না-হতেন, তা হলে হয়তো তিনি শিবাজির মতোই সম্মান পেতেন। বোঝাই যায়, কেবলমাত্র একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে কারনাড কথাগুলি বলেননি। দীর্ঘদিন ধরে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ তাঁকে আরও অনেকের মতোই সরব করে তুলেছে। দেশে যখন এমন পরিস্থিতি, নরেন্দ্র মোদীকে তখন বিলেতের সাংবাদিকদের প্রশ্ন— ‘ভারত ক্রমশ অসহিষ্ণু দেশ হয়ে উঠছে কেন’?
দেশের মাটিতে এ যাবৎ প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়েছেন মোদী। তাঁর নীরবতাকে ঘটনাপ্রবাহের সমর্থন বলেই মনে করেছেন কেউ কেউ। মোদীর পারিষদেরা প্রকাশ্যে বলেছেন, দেশে অসহিষ্ণুতার চিহ্নমাত্র নেই। যাঁরা এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরাই আসলে অসহিষ্ণু। তাঁরা রাজনীতি করছেন। বিলেতের মাটিতে এহেন প্রশ্ন শুনে স্বভাবতই মোদী খুব আনন্দিত হননি। কিন্তু বিষয়টি এড়িয়েও যেতে পারেননি।
বিলেতের সাংবাদিকদের পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা অসহিষ্ণু বলে পাল্টা ধমকও দিতে পারেননি। বরং ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে গৌতম বুদ্ধ, মহাত্মা গাঁধীর নাম। মোদী বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, দু’একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলেও সার্বিকভাবে ভারত সহিষ্ণু বাতাবরণেই বিশ্বাসী। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে পাল্টা যুক্তি নিক্ষেপ করেননি বিলেতের সাংবাদিকেরা। এ বিষয়ে দু’একটি প্রশ্ন করেই তাঁরা ক্ষান্ত দিয়েছেন। ব্রিটিশ ভব্যতা অতিক্রম করেননি। কিন্তু গোটা ঘটনায় দেশের ভিতর আলোড়ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, বিদেশের মাটিতেও যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সহিষ্ণুতার প্রশ্নে অপ্রস্তুত হতে হচ্ছে, তখন সরকার বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দিচ্ছে না কেন !
কেন এত কাণ্ডের পরেও গিরিশ কারনাডের মতো ব্যক্তিত্বকে খুনের হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে ! কেন কালবুর্গি থেকে শুরু করে দাদরি— কোনও ঘটনাকেই আমল দিচ্ছে না শাসক ! প্রশ্নগুলো দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। মনে রাখলে ভাল, বিশ্বের দরবারে ভারতকে আরও উন্নত করার যে সংকল্প মোদী নিয়েছেন, নিজেদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ করতে না-পারলে তা ধোপে টিকবে না।
বিলেত ভারতীয় রাজনীতিকে আরও একটি শিক্ষা দিল। দেশ এবং বিদেশের মাটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম তফাত আছে। দেশে যে কথা সহজে বলা যায়, বিলেতে তা বলা যায় না। শেষ বেশ কয়েকটি বিদেশ সফরে দেশের বিরোধীদের সমালোচনা করেছিলেন মোদী। নিন্দকেরা বলেছিলেন, তাঁর এই সমালোচনা দেশের ভাবমূর্তিটিকেই আসলে ভূলুণ্ঠিত করেছে। বিলেতের সাংবাদিকদের সামনে মোদী যখন নাস্তানাবুদ হলেন, দেশের বিরোধী শক্তি বিষয়টি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। মনে রাখলে ভাল, মোদী নাস্তানাবুদ হননি। অপমানিত হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি। বুদ্ধ-গাঁধীর শান্তি-সংস্কৃতি। এ দায় কেবল মোদী কিংবা বিজেপি’র নয়। এ দায় সকলের।
দিনে দিনে নিজেকে আর কত দীন করবে ভারতীয় রাজনীতি !