সম্বল শুধু মনের জোর আর কন্যাশ্রীর জমানো অর্থ। শিক্ষিকা হয়ে আদিবাসী সমাজে আলোর দিশা দেখানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন এক আদিবাসী তরুণী। কিন্তু বাবার মৃত্যু আর মায়ের দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁর শিক্ষিকা হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও হার মানতে রাজি নন মাধুরী হেমব্রম।
একবেলা খেয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মাধুরী। শিক্ষিকা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দ্বিতীয় বর্ষের টাকা কী ভাবে মেটাবেন, সেই চিন্তা এখন তাঁর মাথায় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাইপুরের আদি বাসিন্দা মাধুরীর পরিবার বছর ৩০ আগে মহম্মদ বাজার থানার আঙ্গারগড়িয়ার নতুন পল্লিতে বসবাস শুরু করেন। বাবা মঙ্গল হেমব্রম দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। মা মুঙ্গলি হেমব্রম এলাকার খড়ি কোম্পানির চট সেলাই করে মেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছেন।
মাধুরীর কথায়, ‘‘অক্ষর-জ্ঞানহীন মা আমাকে পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে পৌঁছে দিতেন পড়ার জন্য। বাংলায় ৪৯ শতাংশ নম্বর নিয়ে স্নাতক হন ওই তরুণী। তার ফলে প্রতিমাসে দু’হাজার টাকা করে স্টাইপেন্ড পেটে শুরু করেন মাধুরী। এর পর তিনি ঠিক করেছিলেন স্নাতকোত্তর করবেন। কিন্তু বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সব ওলট পালট হয়ে যায়।
এর পরে কন্যাশ্রী প্রকল্পে জমানো ২৫ হাজার টাকা দিয়ে মাধুরী একটি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রাথমিক শিক্ষক হয়েই আদিবাসী এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দেবেন তিনি। সেই মতো নিজে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কাজ করে এবং গৃহশিক্ষকতা করে খরচ জোগাড় করছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর মা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। ফলে স্টাইপেন্ডের জমানো টাকা মায়ের চিকিৎসা করাতেই খরচ হয়ে গিয়েছে। ফলে এখনও ওই শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দ্বিতীয় কিস্তির টাকা কী ভাবে শোধ করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় মাধুরী।
মাথা গোঁজার মতো এক চিলতে মাটির ঘরেই শয্যাশায়ী মায়ের পায়ে বসে স্বপ্ন দেখে চলেছেন মাধুরী। তিনি জানান, ‘‘আমি এতদূর যে এগিয়েছি, তার জন্য অবশ্যই কন্যাশ্রী প্রকল্পের অবদান বিরাট। ওই প্রকল্প না থাকলে এটা হতো না।’’ তরুণীর কথায়, মুখ্যমন্ত্রীর প্রেরণা না থাকলে তিনি স্বপ্ন দেখার সাহস পেতেন না। আর পাশের বাড়ির কাকিমা না থাকলে নিরক্ষর এক আদিবাসী মেয়ে হিসাবেই জীবন কেটে যেত তাঁর। কিন্তু মাধবীর আর কলেজ যাওয়া হয় না। কারণ মা-কে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় তাঁকে। কখনও বর্ধমানে, কখনও সিউড়ি হাসপাতালে মায়ের চিকিৎসার জন্য ছুটতে হচ্ছে তাঁকে। তবুও পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণী।
তরুণীর বান্ধবী সুস্মিতা মণ্ডল, মিতালী চৌধুরী, রীতা মণ্ডলরা তরুণী সম্পর্কে বলেন, ‘‘এতই লাজুক মাধুরী, যে অনেকদিন বাড়ি থেকে খেয়ে আসে না। কিন্তু সে কথা বলতেও পারে না মুখ ফুটে। আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে ওর প্রাক্টিক্যাল খাতা থেকে প্রাইভেট শিক্ষকের টাকা দিয়েছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি ও যেন ওর লড়াইয়ে জয়ী হয়।’’ মাধুরী জানান, মহম্মদবাজার এলাকায় আদিবাসী শিক্ষিকা কম। অথচ তাঁরা পড়তে চান। আর তাই শিক্ষিকা হওয়াই প্রধান লক্ষ্য তাঁর।