যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছেই নির্বাচন একটি পরীক্ষা। নির্বাচনের ফলাফলই বলে দেয়, সেই দলের কতটা ক্ষমতা। তাই পাঁচ বছর ধরে যে দলই যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়লে সেই রাজনৈতিক দলের আসল শক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
২০১৯ সালের শুরুতেই সেই পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলি। এই পরিস্থিতিতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে কী হতে চলেছে, তা নিয়েও উৎসাহ রয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
বিভিন্ন উপনির্বাচন ও পঞ্চায়েত নির্বাচনে (যতটুকু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে) পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের ভোটের শতাংশ বাড়িয়েছে বা প্রাপ্ত ভোট ধরে রেখেছে এবং দ্বিতীয় স্থানে বামেদের সরিয়ে উঠে এসেছে বিজেপি।
সেই হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে ২২টি আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছেন। কোনও কোনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের ধারণা, অত না হলেও ৬টি বা ৭টি আসন তো পেতেই পারে বিজেপি।
এক বার দেখা যাক, একটি নির্বাচনে জেতার জন্য কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়।
প্রথমত, ভোট হল একটি টি-২০ ম্যাচ। নির্বাচনের দিন কী হয় তার উপরও অনেকটাই নির্ভর করে ফলাফল। মানে সেদিন রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারল কি না, ভোটাররা গোপনে কাকে ভোট দিল, বিনা বাধায় ভোটগ্রহণ হল কি না ইত্যাদি ঠিক করে দেয় ফলাফল। তার জন্য লাগে নিখুঁত সংগঠন। প্রতিটি বুথে এজেন্ট রাখা, ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে বুথে নিয়ে আসা ও প্রশাসনকে হয় নিজের হাতে রাখা বা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে সাহায্য করার মধ্যেই সেই টি-২০ ম্যাচের ফলাফল নির্ভর করে।
দ্বিতীয়ত, অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি বা শাসক-সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা জনমত। ভোটাররা যদি ঠিক করেন, এই শাসক দলকে আর চাই না, নতুন কাউকে আনতে হবে তখ্তে, তা হলে পরিবর্তন হতে পারে। তবে তার জন্য শাসক দলের উপরে তীব্র ঘৃণা জন্মাতে হবে এবং ‘নতুন’ কারোকে তৈরি থাকতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রচারের সময় থেকেই কোনও বিশেষ নেতার বা রাজনৈতিক দলের দিকে প্রবল হাওয়া। সেই হাওয়া যদি ভোটারদের খুব প্রভাবিত করতে পারে, তবে তাতেই উড়ে যেতে পারে বিপক্ষ।
চতুর্থত, শাসক দলের মধ্যেই যদি কোনও অন্তর্ঘাত হয় বা দলের মধ্যেই কোনও দুর্বলতা তৈরি হয়, তাহলে তার ফায়দা লুটতে পারে বিপক্ষ।
এ ছাড়াও টুকরো অনেক ফ্যাক্টর কাজ করতে পারে কোনও ভোটের ফলাফলের পিছনে। কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখলে, এই চারটি ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা ঠিক কী?
অমিত শাহ চাইলেও এবং বাইরে থেকে নেতাদের পাঠালেও সাংগঠনিক দিক থেকে বিজেপি এখনও অতটা পোক্ত নয়। কোনও কোনও বুথে সংগঠন তৈরি হলেও লোকসভা ভোট জেতার মতো সংগঠন এখনও তৈরি করতে পারেনি বিজেপি। মুকুল রায়ও বিশেষ কিছু করতে পারেননি। তৃণমূল ভাঙিয়ে অন্য কারোকে নিয়ে এলেও এত কম সময়ে সারা রাজ্য জুড়ে নিখুঁত সংগঠন গড়ে তোলা কঠিন।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনমত এরকম অবস্থায় পৌঁছায়নি যে, দলে দলে জনগণ বিজেপিকে ভোট দেবে।
স্থানীয় ভাবে কোনও কোনও এলাকায় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হলেও, তার প্রতিফলন লোকসভা নির্বাচনে পড়বে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছে। কারণ, যেখানে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঠিক মতো হয়েছে, সেখানে দেখা গিয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে বিরোধীদের জেতালেও, জেলা পরিষদ স্তরে শাসক দলকেই ভোট দিয়েছেন একই ভোটার।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে তীব্র হাওয়া থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তার প্রভাব ছিল খুবই ক্ষীণ। সেই রকম হাওয়া তোলার সম্ভাবনা ২০১৯ সালে প্রায় নেই। যদিও বা রাম মন্দির বা জাতীয়তাবাদ বা আবার দুর্নীতি-মুক্ত ভারতের হাওয়া তোলার চেষ্টা হয়, তার প্রভাব এই রাজ্যে কতটা পড়বে তা নিয়ে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না। আর রাজ্যে বিজেপির সেই হাওয়া তোলার মুখই তো নেই।
তবে শাসক দলের মধ্যে যুব ও মূল তৃণমূলের যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, তার ফল ভুগতে হতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কোনও নেতা এতটা শক্তি কী দেখাতে পারবেন যে, তিনি একটি লোকসভা আসনের ফলাফল ঘুরিয়ে দেবেন? সিপিএম-এর প্রয়াত নেতা সুভাষ চক্রবর্তী যেমন দমদম কেন্দ্রের ফলাফল ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই রকম তৃণমূলের কেউ যদি ক্ষমতা দেখাতে পারেন, তাঁকে বাহবা দিতেই হবে।
কাজেই, শেষ ফ্যাক্টরটি ছাড়া ২০১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেমন ভয় করার কোনও কারণ নেই। আর বিজেপির বর্তমান অবস্থাই তাঁকে অভয় দিতে পারে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাঁর চিন্তা বাড়তেও পারে। তবে এই মুহূর্তে তিনি বরং ভাবতে পারেন জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা কী হতে চলেছে, সেই নিয়ে। ২০১৪ সালে এত আসন জিতেও কোনও লাভ হয়নি। এ বার তিনি কী করার কথা ভাবছেন, তা একটি ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে।