সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনি ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এর ক্লাইম্যাক্স গিয়ে ঠেকেছিল ঝাড়খণ্ডের (তখন বিহার) রামগড় জেলার এই মন্দিরটিতে। সন্দেহ হয়, মানিকবাবু তাঁর রহস্য কাহিনির পটভূমিকায় ছিন্নমস্তাকে রেখেছিলেন একটা জবরদস্ত ব্যাকড্রপ হিসেবে। দেবীর ভয়াবহ রূপটিকে পিছনে রেখেই জটিল হয়েছিল রহস্য আর তদন্ত।
মহাশক্তির দশটি মহাবিদ্যাকে নিয়ে ভাবতে বসলে অনেকের কাছেই কয়েকটি রূপ অস্বস্তিকর ঠেকতে পারে। বিশেষ করে ধূমাবতী এবং ছিন্নমস্তার রূপ সত্যিই ভয়ের আবহ তৈরি করার সামর্থ্য রাখে। মহাবিদ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী, ধূমাবতী ঘোর রহস্যময় এক শক্তি। কিন্তু দেবী ছিন্নমস্তা দর্শনে যত ভয়ঙ্করী হোন না কেন, তাঁর রূপের ব্যাখ্যা আর মহিমা জানা থাকলে ওই ভয়াবহ মূর্তিই প্রেমময় বোধ হবে। দেবী ছিন্নমস্তা সারা দেশেই পূজিতা। কিন্তু ছিন্নমস্তার মহিমাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে গেলে পৌঁছতে হবে রাজরাপ্পায়।
রামগড় ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৮ কিমি দূরত্বে এক টিলার উপরে এই মন্দির। কাছেই বিখ্যাত রাজরাপ্পা ফলস, দামোদর আর ভৈরবী নদীর মোহনা। পুরুষ দামোদরের বুকে জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া নারী ভৈরবীর দৃশ্য শুধু প্রাকৃতিক বৈভবের কথা বলে না, এই জলতরঙ্গে মিশে থাকে কাহিনি-কিংবদন্তি-মিথ। তবে রাজরাপ্পার আসল আকর্ষণ তার প্রকৃতি নয়, এ কথা রাজরাপ্পায় আগত সব পর্যটকই জানেন।
রাজরাপ্পার ছিন্নমস্তা মন্দির অতি প্রাচীন। এই দেবস্থানকে অন্যতম শক্তিপীঠ বলে মনে করেন তন্ত্রবিশ্বাসীরা। দেবীরূপ অবশ্য ততটা প্রাচীন নয়। ছিন্নমস্তার মূর্তি একেবারেই শাস্ত্রানুগ এখানে। দেবী নিজহস্তে ধরে রেখেছেন তাঁর ছিন্ন মস্তক। কণ্ঠ থেকে নির্গত হচ্ছে তিনটি রুধিরধারা, যার মধ্যধারাটি পান করছেন দেবী স্বয়ং। বাকি দু’টি ধারা গিয়ে পড়ছে তাঁর দুই সহচরী যোগিনীদের মুখে। দেবীর পদতলে শায়িত রয়েছেন রতিদেবী ও মদনদেব। দেবী কামদলনী। মোক্ষস্বরূপা। এই ত্রিধারাকে ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার প্রতীক বলে ধরা হয়। কামকে দলন করে কুলকুণ্ডলীনির জাগরণকেই ব্যক্ত করে এই মূর্তি। ছিন্নমস্তার উৎস সন্ধান করতে হলে যেতে হবে ‘মহাভাগবৎ পুরাণ’-এ। দক্ষ শিবরৃকে তাঁর যজ্ঞা আমন্ত্রন না জানানোয় ক্রুদ্ধ সতীদেবী দশ মহাবিদ্যের রূপ ধরেন। ছিন্নমস্তা তাঁদেরই অন্যতম। তাঁরা শিবকে কেন্দ্র করে দশ দিকে অবস্থান করেন। ছিন্নমস্তার অবস্থান শিবের ডানদিকে।
ছিন্নমস্তা দর্শনের পরেই রয়েছে রাজরাপ্পার দু’টি উষ্ণ প্রস্রবণ। এখানকার জল বহু রোগের উপশম ঘটায় বলে লোকবিশ্বাস।
রাজরাপ্পা দেবী মন্দিরের ভৈরব হলেন রুদ্র মহাদেব। তিনিই এই মন্দিরে রক্ষক হিসেবে পূজিত। মন্দিরে দেবীর শিলারূপ বিদ্যমান। মূল মন্দিরকে ঘিরে মহাবিদ্যাদের অন্যান্য মূর্তিরও মন্দির এখানে রয়েছে। রয়েছে হনুমান ও সূর্যের মন্দিরও।
রামগড় থেকে গাড়িতে ছিন্নমস্তা মন্দির যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। রামগড়ে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল রয়েছে।